মডেলকন্যা তিন্নি খুনের আসামি অভি’র সন্ধান করতে পারেনি ইন্টারপোল

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৩-৯-২০২১ দুপুর ১১:৩২

8Views

 নব্বই দশকের ত্রাস মডেল কন্যা খুনের পলাতক আসামি গোলাম ফারুক অভির সন্ধান করতে পারেনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। চাঞ্চল্যকর মডেলকন্যা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি (২৪) হত্যামামলার গ্রেফতারি পরোয়ানার ফেরারি আসামি অভি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। 
সূত্র জানায়, গত ২০০৭ সালে ইন্টারপোল অভির বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করে। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছরেও তার কোনো সন্ধান বা কোনো প্রকার তথ্য ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরকে জানাতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের ১ নম্বর চীন-মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশ থেকে মডেল কন্যা তিন্নির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন পুলের এএসআই সফিউদ্দিন বাদি হয়ে হত্যামামলা করেন। আলোচিত মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ূম আলী সরদার। লাশটি উদ্ধারের পর অজ্ঞাতনামা হিসেবে তিন্নির লাশের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। এর আগে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় সাধারণ একটি ডায়রি করেন। আর তার লাশটি অজ্ঞাতনামা হিসেবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম জুরাইন কবরস্থানে নিয়ে দাফন করে। পত্রিকায় ছাপানো ছবি দেখে সুজন নামে তার এক আত্মীয় ও তিন্নির স্বামী লাশটি মডেলকন্যা তিন্নির বলে শনাক্ত করেন। এরপর ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
মডেলকন্যা তিন্নি হত্যা মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত করা হয়। আর তদন্তের দায়িত্ব প্রথমেই পান তৎকালীন সিআইডির পরিদর্শক ফজলুর রহমান। এরপর দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী এবং ২২টি আলামত জব্দ দেখানো হয়েছে। সিআইডি দীর্ঘ ৬ বছর তদন্তের পর ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর হত্যা মামলায় একমাত্র আসামি গোলাম ফারুক অভি কে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জসিট দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মডেল কন্যা তিন্নি খুনের মামলায় প্রথমে তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন ওরফে পিয়ালকে গ্রেফতার করে। পরে আরো চার জন গ্রেফতার হন। কিন্তু হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাদেরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে গোলাম ফারুক অভি অভিযুক্ত হলেও তাকে ধরতে পারেনি পুলিশ। এরপর ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত অভির অনুপস্থিতিতেই ২০১০ সালের ১৪ জুলাই তিন্নিকে খুন ও তার লাশ গুমের মামলায় অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। 
মডেল কন্যা তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের মাধ্যমেই তিন্নির সঙ্গে অভির পরিচয় হয়েছিল। একপর্যায়ে তিন্নি ও অভির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। স্বামী পিয়াল বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে অভি ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর পিয়ালকে ডিভোর্স করতে বাধ্য করায়। ওই দিন তিন্নির দেড় বছর বয়সী কন্যা সন্তানসহ পিয়ালকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও তিন্নিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি অভি। পরে বিষয়টি তিন্নি বুঝতে পেরে বিয়ের জন্য অভিকে চাপ দেন। কিন্তু অভি তিন্নিকে বিয়ে অস্বীকার করায় তার গোপন তথ্য মিডিয়ায় ফাঁস করার হুমকি দেন তিন্নি। পরে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও ত্রাস গোলাম ফারুক অভির উত্থান ঘটে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার সাক্ষর রাখেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলন ঠেকাতে এরশাদ এর নেক নজর পান এই অভি। তখন রাজধানীতে অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজিসহ নানা ঘটনার নায়ক ছিলেন তিনি। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী ছিল। একপর্যায়ে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চরম পর্যায়ে কারাগার থেকে তৎকালীন সরকার তাকে ছেড়ে দেয়। ওই দিন সন্ধ্যায় এ্যাম্বুলেন্স যোগে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ গেট থেকে শাহবাগ মোড়সহ ক্যাম্পাসে সারারাত ব্রাশফায়ার ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এরপরও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে ১৯৯৬ সালে বরিশাল-২ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গোলাম ফারুক অভি পলাতক থেকেও তার নিজ এলাকায় ঈদের জামাতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করে থাকেন বলে স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়। আর তিন্নি খুনের পর থেকেই অভি পলাতক অবস্থায় কানাডায় পাড়ি জমান। পলাতক অবস্থায় উচ্চ আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মামলাটি স্থগিতের আদেশ পান। পরবর্তীতে মামলার স্থগিতাদেশ বাতিল সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে না যাওয়ায় মামলার কার্যক্রম এক প্রকার থমকে থাকে। 
আদালত সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দেন। পরে একই বছরের ২৫ আগস্ট মামলাটির কার্যক্রম উচ্চ আদালত স্থগিত করেন। তিন্নির বাবা বিদেশ থেকে এসে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝপথে মামলা স্থগিত হলে তিনি আবার বিদেশে চলে যান। 
পুলিশ সদরদপ্তরের সূত্র জানায়, সাবেক সাংসদ জাতীয় পার্টির নেতা গোলাম ফারুক অভি মডেল কন্যা তিন্নি হত্যামামলায় সিআইডির তদন্তে অভিযুক্ত হলে তার সন্ধান চেয়ে ২০০৭ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের সদরদপ্তরে আবেদন করে। পরে ওই বছরের ২৭ জুন গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিস জারি করে। আর রেড নোটিস জারির পর প্রতি ৫ বছর পর পর পুনরায় আবেদন করতে হয়। এরপর পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পুনরায় অভির বিরুদ্ধে আবেদন করলে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি ইন্টারপোল পুনরায় রেড নোটিস জারি করে। কিন্তু ইন্টারপোল অভির ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে কোন তথ্য দিতে পারেনি। পুনরায় ওই রেড নোটিসের ৫ বছর পূর্ণ হলে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি পুনরায় আবেদন করে বাংলাদেশ পুলিশ। আর একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ইন্টারপোল অভির বিরুদ্ধে আবারো রেড নোটিস জারি করে। ওই রেড নোটিশ আগামি ২০২২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-ইন্টারপোল) মহিউল ইসলাম এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সকালের সময়কে বলেন, অভির বিষয়ে পুরো ফাইল দেখে প্রতিবেদক কে তথ্য জানাবেন বলে জানিয়েছেন।


আরও পড়ুন