মুনিয়ার ডিএনএ ও পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধর্ষণের পর হত্যা

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৪-৯-২০২১ রাত ১০:৪৫

16Views

 বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে কলেজ ছাত্রী মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা মামলাটি ডিএনএ ও পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ভিন্ন মোড় নিয়েছে। আর এই মামলার তদন্তে মাঠে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই এর অর্গানাইজ ক্রাইম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সারোয়ার জাহান ‘সকালের সময়কে’ মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত শুরু করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন, পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক গোলাম মোক্তার আশরাফ উদ্দিন। তিনি গত রোববার বিকালে ঘটনাস্থল গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়ির সেই ফ্ল্যাট পরিদর্শন করেছেন। আর আলোচিত এ মামলাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ জানিয়েছে।
অপরদিকে নিহত মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদি নুসরাত জাহান তানিয়া ও তার স্বামী মিজানুর কয়েকদিন ধরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আর এ বিষয়ে গত শনিবার কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি-নম্বর-৬৭৭) করেছেন মিজান। এর আগে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে গুলশান থানায় মামলাটি রেকর্ডকৃত চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেন আদালত।
জানা গেছে, বহুল আলোচিত বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনার পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের প্রেমিকা কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২২) রহস্যজনক মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ২-৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।আর ডিএনএ পরীক্ষায় নিহম মুনিয়ার পরনের সব কাপড়ে পুরুষের ডিএনএ রয়েছে। আবার ডাক্তারি পরীক্ষায় মৃত্যুর পূর্বে মুনিয়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষিত হওয়ার কথাও পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এমন ভয়ঙ্কর তথ্য-প্রমাণ সামনে আসায় মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। ফলে তদন্তে ধর্ষণের পর হত্যা মামলাটি নতুন মোড় নিয়েছে বলেও মামলার বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন মনে করছেন।
জানা গেছে, মুনিয়ার প্রেমিক ও মামলার প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ আটজনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের দায়েরকৃত মামলাটি মূলত আগের মামলা। গুলশান থানায় দায়েরকৃত পূর্বের মামলাটিই এখতিয়ারভুক্ত সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ঘটনার পর বাদী এ মামলা দিতে চাইলেও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অংশ হিসেবেই বর্তমান দায়েরকৃত মামলার এই ধারায় পুলিশ মামলা গ্রহণ করেনি।
এদিকে মামলার বাদি ও তার স্বামীর জীবন নাশের আশঙ্কায় কুমিল্লায় থানায় এতটিজিডি করা হয়েছে। ওই জিডিতে  বাদির স্বামী মিজানুর রহমান উল্লেখ বলেছেন, মুনিয়াকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী নুসরাত জাহার  গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা (১০৮/২১) করেন। ওই মামলার পর আসামিরাসহ স্থানীয় মহি উদ্দিন মোল্লা (৫০), সাং চাঁনপুরসহ আরো অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জন সহযোগী তাকে (মিজান) তার বাসা এলাকায় খোঁজাখুঁজি করছে। যদিও তারা ব্যাংকের লোক হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেয়। আশঙ্কা প্রকাশ করছি, মামলার আসামি পক্ষ আমাদের পরিবারের সদস্যদের কিংবা সাক্ষীদের ক্ষতিসাধন করতে পারে।
বহুল আলোচিত এই নতুন মামলার বিষয়ে মুনিয়া হত্যা মামলা বাদী তার বোন নুসরাত জাহান তানিয়ার অন্যতম প্রধান আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন বলেছেন, আলোচিত এই মামলাটির তথ্য-প্রমাণের কোনো অভাব নেই। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষায় মুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা, তার পোশাকে পুরুষের ডিএনএ পাওয়া ছাড়াও মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষিত হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এরপর প্রধান সন্দেহভাজন আসামি বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনার পরিচালক (এমডি) আনভীরের ডিএনএ পরীক্ষা করাই অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা তা না করেই দায়িত্বহীনতা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে বলে বাদির আইনজীবী মনে করছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, মুনিয়ার মৃত্যুর পর তার বড় বোন যেভাবে গুলশান থানায় অভিযোগ দিয়েছেন, সে অনুসারে মামলা নেয়নি পুলিশ। এটি মূলত সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত মামলা। সেভাবে মামলা গ্রহণ করে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে পাঠানো পুলিশের উচিত ছিল। আদালতে নতুন করে আবেদনের ফলে মূলত প্রথম এজাহার দেয়া মামলাটিই প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে মামলার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া মুনিয়ার ভাই আশিকুর রহমান সবুজ যে হত্যা মামলার আবেদন করেছিলেন, সেটি মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়নি। একটি মামলা চলমান থাকায় সেটি স্থগিত রেখেছিলেন আদালত। ফলে মুনিয়া হত্যার ঘটনায় তিনটি নয়, মাত্র একটি মামলাই রয়েছে, এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। আর মামলার আসামি বিচারিক প্রক্রিয়ায় খালাস পাননি বলেও মামলার আইনজীবী জানিয়েছেন।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ আদালতে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে গত  ৬ সেপ্টেম্বর এই মামলা দায়ের করেন। এই আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ বেগম মাফরোজা পারভীন মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলে নির্দেশ দেন। ওইদিন দুপুরে নুসরাতের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত।
আদালত সূত্র জানায়, কলেজ ছাত্রী মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার চাঞ্চল্যকর এই মামলায় প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর (৪২)। আর তার বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (৭০), মা আফরোজা সোবহান (৬০), আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা (৪০), হুইপপুত্র শারুনের সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মিম (৩৫), কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, পিয়াসার বান্ধবী ও ঘটনাস্থল গুলশানের ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী শারমিন (৪০) ও তার স্বামী ইব্রাহিম আহমেদ রিপন সহ (৪৭) ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ৭ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) (২)/৩০ ধারা এবং ৩০২/৩৪ ধারার মামলাটি (নম্বর-৫) রেকর্ড হয়। তদন্তের জন্য ওই দিনই পাঠানো হয় পিবিআইতে।
চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আর ওই রাতেই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন নিহত মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। মামলায় অভিযোগ তিনি বলেছেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সায়েম সোবহান আনভীর দীর্ঘদিন মুনিয়ার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আর সেই বাসায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু বিয়ে না করে তিনি উল্টো হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন মুনিয়াকে। তার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে আনভীর। তদন্ত শেষে গত ১৯ জুলাই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে গুলশান থানা পুলিশ জানায়, আসামির আনভীরের সঙ্গে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হোক। এর বিরুদ্ধে আদালতে না-রাজি দেন বাদী নুসরাত। গত ১৮ আগস্ট পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ করে ও বাদীর আবেদন খারিজ করে আসামিকে অব্যাহতি দেন ঢাকার সিএমএম আদালত।
উল্লেখ্য, গত ২৬ এপ্রিল গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন বাদি হয়ে গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে।


আরও পড়ুন