৭ নভেম্বর ৭৫-এর তৃতীয় কলংকিত অধ্যায়ের দায় কার!

news paper

জিয়াউদ্দিন লিটন

প্রকাশিত: ৬-১১-২০২১ দুপুর ৩:১৯

16Views

১৯৭১ সালে ত্যাগ,সাধনা আর রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের এক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কাজী মুহাম্মদ (কে এম) শফিউল্লাহর স্থলে সেনাবাহিনী উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রতিস্থাপন করেছেন। পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানের অপসারণকে স্বাগত জানায় এবং চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপনের জন্য বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান অনিচ্ছুক বা এটি করতে অক্ষম প্রমাণিত হন। সেনাবাহিনী ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অসন্তোষ ছিল এবং কর্ণেল শাফায়াত জামিল ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের এর মতো অফিসার খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কলঙ্কিত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সংঘটিত হতে সময় লেগেছিলো ৪ বছর, কলঙ্কিত ৩ নভেম্বর হতে সময় লেগেছিলো ২মাস ১৮ দিন কিন্তু ৭নভেম্বরের জন্য সময়  লেগেছিলো মাত্র ৪ দিন। ঘটনাগুলো ঘটছিলো খুব দ্রুত। কিসের এতো তাড়া ছিলো আজও অপ্রকাশিত।যা কিছু আমরা বলি সবই ঘটনাচক্র শুনে আর যুক্তির  উপর নির্ভর করে।  ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুত্থান, যাকে অনেকে সিপাহি ও জনতার বিপ্লব, জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বা মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস বলে আখ্যায়িত করেন, এটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বামপন্থী রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় বামপন্থী সেনা সদস্যরা শুরু করেছিল। এই অভ্যুত্থানে খালেদ মোশারফকে হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এই  অভ্যুত্থানের ফলে  জিয়াউর রহমান গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান।  "কথা ছিল সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে  ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলিফেন্ট রোডে নিয়ে আসবে। সেখানেই একটি বাসায় কর্নেল তাহেরসহ জাসদের নেতারা অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তারা সেটা করতে পারেনি"। অধ্যাপক হোসেন বলছেন, গণবাহিনীর সাথে যুক্ত সৈনিকরাই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিল। "জিয়াউর রহমান তাদেরকে বলেছিলেন যে কর্নেল তাহের তার বন্ধু এবং তাকেই যেন তারা এখানে নিয়ে আসে। এভাবে তারা কিছুটা প্রতারিতও হয়েছিল। তাদের ওপর যে সুনির্দিষ্ট যে নির্দেশ ছিল সেটা তারা করতে পারেনি"।

আগের লেখাতে বলেছিলাম, মানবতা লংঘনকারী নির্মম হত্যাকান্ডগুলো এমন এক সময়ের ইতিহাস। এগুলোকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে গবেষণা  এবং  বিশ্লেষন না করা ও তার থেকে শিক্ষা না নেবার বিষয়টিও ছিল অন্যতম এক কারণ, যে জন্যে আমরা আজও সত্যিকারের এক সভ্য রাষ্ট্ররুপে পরিগণিত হতে পারিনি। যে কারণে আজও বাংলাদেশ লাভ করেনি মানসিক স্বস্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই বিষয়গুলো নিয়ে নির্মোহভাবে ও যুক্তি তথ্যের আলোকে মৌলিক গবেষণা আমাদের দেশে খুব কমই হয়েছে। যাহোক, ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এ মোশতাক চক্রের ষড়যন্ত্রে বিপদগামী ফারুক রশীদ গংদের হাতে সপরিবারে  নির্মমভাবে নিহত হন স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পর এর সাথে যুক্ত মেজরদের সাথে নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন। তবে খন্দকার মোশতাক সামনে থাকলেও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী। সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ফুঁসতে থাকেন তীব্র ক্ষোভে। চেইন অফ কমাণ্ড ভেঙে পড়ায় তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়  মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মাঝে।সেনাসদরের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই গর্জন করে ওঠেন কর্ণেল শাফায়াত  জামিল, “Mostak is a bloody betrayar .I will overthrow him on the first chance I get “চারদিকে টানটান  উত্তেজনা। অবশেষে ৩ থেকে ৭ নভেম্বর দ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। কয়েকজন মেজর আর  কর্নেলকে নিয়ে খন্দকার মোশতাক দেশে একটা অরাজকতা চালাচ্ছিলো। এই অবস্থার অবসানের ও সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমাণ্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটা ক্যু সংগঠিত করেন।বন্দী করে মোশতাক চক্রকে।কিন্তু, জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর মধ্যস্থতায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ বেঁচে যায়। অথচ জেলে নির্মমভাবে  নিহত হন জাতীয় চার মহান নেতা। অন্যদিকে ওসমানীর মধ্যস্থতা মেনে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় মূল্যটাও পরিশোধ করেন খালেদ মোশাররফ। বলতেই হয় যে, সেক্টর কম্যাণ্ডারগণ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ  পরিচালনার মূল নেতাদের কাছে খালেদ মোশাররফ-ই মুক্তিযুদ্ধকালীন দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিলেন জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী’কে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করার জন্যে।কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নে বিভোর জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা ক্যু সংগঠিত করে মাত্র ৪ দিনের  মাথায়।

যাইহোক, খালেদ মোশাররফের মতোই কর্নেল তাহের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করে যা জীবন দিয়ে কড়ায় গণ্ডায় মূল্য দিতে হয় কর্নেল তাহেরকে। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যূত্থান সফল হয় ৭ নভেম্বর। কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাণপণে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। পাল্টা এই অভ্যূত্থানে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা দাবার গুটির চালের মতো ব্যবহৃত হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে তাঁরই একান্ত ব্যক্তিগত দেহরক্ষী পিছন থেকে হত্যা করে ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫।পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর বিভক্ত দুই গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে শত শত সৈনিক, কর্মকর্তা,সিপাহি-জনতা নিহত ও আহত হয়।এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনঃ কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা লে কর্নেল হায়দার বীর উত্তম, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী কর্নেল নাজমুল হূদা বীর বিক্রমসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার।অবশেষে খালেদ মোশাররফকে হত্যার মধ্য দিয়ে তথাকথিত বিপ্লবের নামে সূচনা হয় মুক্তিযোদ্ধা নিধনযজ্ঞের মিশন। জিয়া ক্ষমতা পেয়েই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করেন কর্ণেল তাহেরকে। গ্রেফতার করা হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার শত শত সৈনিককে। গোপন বিচারে রাতের আঁধারে  ফাঁসিতে ঝোলানো হয় অধিকাংশকে। শুরু হয় এদেশের পেছল পথে চলার পালা।

৭ই নভেম্বর দিবাগত রাতেই শুরু হয়ে যায় পাল্টা অভ্যুত্থান। যার পুরোভাগে ছিল সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। কে এম শফিউল্লাহ বলছিলেন, সৈনিকদের মধ্যে স্লোগান উঠছিল 'সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, জেসিও ছাড়া র‍্যাংক নাই'।"সিপাহীদের মধ্যে একটা হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ভাবছিল অফিসাররা তাদের ব্যবহার করে উচ্চপদে উঠছে কিন্তু তাদের কথা কেউ চিন্তা করে না"। সেই রাতেই মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে। ৭ তারিখ রাতে ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলির শব্দ শুরু হয়। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। "জিয়াউর রহমানকে গণবাহিনী বের করতে পারেনি, তাকে রাতের বেলা বের করলো ফোর বেঙ্গল আর টু ফিল্ড রেজিমেন্ট"। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনের বর্ণনানুযায়ী পরদিন সকালেই তিনি গণবাহিনীর সদস্য এবং কিছু সেনাসদস্যসহ সেনানিবাসে কর্নেল তাহেরকে দেখতে পান । এরপর জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলার সময় একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়।"তাহের চাচ্ছিলো জিয়াউর রহমান রেডিওতে গিয়ে গণবাহিনীর ১৩ দফা ঘোষণা করবেন এবং বলবেন যে তিনি এসব দাবী মেনে নিয়েছেন। এরপর সিপাহী-জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সেই দাবী মেনে নেয়ার কথা জানাবেন"। "কিন্তু তিনি যাননি। উনি তার আগেই তার ভাষণ রেকর্ড করে রেডিওতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই তাহের এবং জিয়ার বিচ্ছেদ"। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেছেন, ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় জওয়ানদের সাথে অনেককে অস্ত্রসহ বেসামরিক পোষাকেও অংশ নিতে দেখা  গিয়েছিল।  তবে ঐ অভ্যুত্থানে গণবাহিনী তাদের বেসামরিক সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি বলছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলছেন, জাসদ যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল সেটি ব্যর্থ হবার এটিও একটি কারণ।

এদিকে ৭ই নভেম্বর সকালেই কর্নেল কে এন হুদার সাথে ঢাকায় রংপুর থেকে আসা ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফ, কর্নেল কে এন হুদা এবং ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারকে। খালেদ মোশারফকে কার নির্দেশে এবং কেন হত্যা করা হয়েছিল তার কোন সুনির্দিষ্ট তদন্ত হয়নি এবং সেই হত্যার কোন বিচারও এখনো পর্যন্ত হয়নি। আনোয়ার হোসেন বলছেন, জিয়াউর রহমানের রেডিও ভাষণের পর অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর ভূমিকা চাপা পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্মে যে, এটি পুরোপুরিই জিয়াউর রহমানের অভ্যুত্থান। ৭ই নভেম্বরের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। এর কিছুদিন পর ২৪শে নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। দীর্ঘদিন পর ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কর্নেল তাহেরের সেই বিচারকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের মে মাসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করা হয়।


আরও পড়ুন