নির্বাচনী সহিংসতা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠ নির্বাচনের প্রধান অন্তরায়

news paper

জিয়াউদ্দিন লিটন

প্রকাশিত: ১৩-১১-২০২১ বিকাল ৫:০

69Views

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন অপরিহার্য। দেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্রের চর্চা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সুষ্ঠ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটে। দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশে  নির্বাচনের সময় কিংবা তার আগে নানা ধরনের সহিংসতা ঘটে থাকে। এসব সহিংসতার মধ্যে রয়েছে খুন, অপহরণ, জালভোট, অগ্নিসংযোগ ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই। নির্বাচনে খুনোখুনি, ব্যালট পেপার বা বাক্স ছিনতাই এবং আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটলেও তা নিরসনে কোনো দলই শক্ত ভূমিকা পালন করেনি, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করে বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দেয়া হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই অনিয়ম-সহিংসতা। স্থানীয় নির্বাচনেও অনিয়ম-সহিংসতা-রক্তপাত! অথচ স্থানীয় সরকার সংস্থা তথা তৃণমূলের নির্বাচন রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র চর্চার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নির্বাচনে কম-বেশি অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা উন্নয়নশীল অনেক দেশে ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারে ভিন্ন। নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতা যেভাবে গেড়ে বসেছেন সহনশীলতার গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। অনেকটা নির্বাচন ও সহিংসতা একে অপরের পরিপূরক। নির্বাচন মানেই অনিয়ম-সহিংসতা! সরকারে পূর্ব ঘোষণার প্রেক্ষিত ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।এরই অংশ হিসেবে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হল দ্বিতিয় ধাপের স্থানীয় সরকারের তৃণমূলের ভিত্তি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন। ভোটকেন্দ্র গুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। তবে বেশকিছু স্থানে হতাহতের ঘটনা শান্তিপূর্ণ ভোটকে সহিংস করে তোলে।এসব ঘটনায় প্রায় শ’খানেক নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হয়। শুধু তাই নয় নির্বাচনের পিছু ছাড়ছে না সহিংসতা, তেমনি অনিয়মও। অনিয়মের অভিযোগে বেশকিছু এলাকায় নির্বাচন স্থগিতের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি জাল ভোট প্রদানের প্রচেষ্টাও হয়েছে অনেক জায়গায়।  নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে ভোটের দিন এবং এর পূর্বাপর সময়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। এখনো তা ঘটছে। এটা যেন এই নির্বাচনী সংস্কৃতিরই অংশ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকেও বলা যায়, এ দেশে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তারের কারণে সহিংসতার আশঙ্কা বরাবরই থেকে যায়। জনবল সঙ্কটজনিত কারণে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা যায় না। একসঙ্গে সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হতো তা সহজেই অনুমেয়।ধাপে ধাপে নির্বাচন হচ্ছে, অথচ পরিস্থিতি সামাল দিতে পেতে হচ্ছে বেগ। কারণ মূলত পুলিশের স্বল্পতা। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়া, কোথাওবা ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না দেয়ার ঘটনা এবারের দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ঘটেছে। সংঘাতহীনভাবে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থান ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীল মনোভাবের ঘাটতি এবারো দেখা গেছে।এভাবে চলতে থাকলে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের হালহকিকত কোন পর্যায়ে তার একটা চিত্র এই নির্বাচনে পাওয়া যাচ্ছে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের সহিংসতার নজির বিরল নয় অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে, এখনো তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কোনো ধরনের সহিংসতা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠ নির্বাচনের প্রধান অন্তরায়। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে সারা দেশে সহিংসতায় ৪১ জন মারা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগের এক সপ্তাহে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় অন্তত ৩৮ জন প্রাণ হারায়। আহত হয় কমপক্ষে ১ হাজার ৬৭২ জন। এছাড়া ২০০৮ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী দলের ২৭ দিনের হরতাল-অবরোধে প্রায় দেড়শ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ব্যালট পেপার ও নির্বাচনী সামগ্রী লুটপাট শুরু হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় প্রায় দেড়শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের পাঁচ শতাধিক ভোট কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ ও স্থগিত করা হয়। ২ জন প্রিসাইডিং অফিসারসহ ৫৭ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। অতীতের এসব ঘটনা আমাদের নিঃসন্দেহে ভীতিকর।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর মনোনয়ন প্রত্যাশী দুই পক্ষের সংঘর্ষের জের ধরে রাজধানীর আদাবর এলাকায় আরিফ ও সুজন নামে দু’জন দরিদ্র কিশোর নিহত হয়েছে। এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে ভয়ানক তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। উপড়ে ফেলা হয়েছে রেললাইন, সড়কে অবরোধ দিয়ে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, জীবন্ত মানুষকে পুড়ে ফেলা হয়েছে; যা ইতিহাসের নিকৃষ্ট ঘটনা হিসেবে মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।

গতকাল দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৮৩৪টি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এতে সহিংসতায় নরসিংদীতে ৩ জন, কক্সবাজারে ১ জন, চট্টগ্রামে ১ জন ও কুমিল্লায় ২ জনসহ মোট ৭ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক। তবে অনেক ইউনিয়নেই সুষ্ঠভাবে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। চলমান ইউপি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, তাই বেশিরভাগ নির্বাচনী সংঘর্ষ আওয়ামী লীগ মনোনিত ও তাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘঠিত হয়েছে। এছাড়া এলাকাভিত্তিক প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তার নিয়েও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্যমতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ নভেম্বর  পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন,বিএনপি’র ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক  মারা গেছেন। গতকাল নির্বাচনে ৭ জন নিহত নিয়ে মোট মারা গেছেন ৯২ জন। সহিংসতাগুলো বেশিরভাগই ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সংঘঠিত হয়েছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিলমারা, ককটেল বিস্ফোরণ, দফায় দফায় সংঘর্ষ, টেঁটাযুদ্ধ, গুলি ও মারামারির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়নের ৮৩৪টি ইউনিয়নে ভোগ গ্রহণ হয়েছে। এরমধ্যে কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে কোনো ভোটগ্রহণ হয়নি। এছাড়া ৭টি ইউনিয়নের ভোট স্থগিত ও ১টি বাতিল করা হয়েছে। ২৬টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে।

কোনো ক্ষেত্রেই সহিংসতা কাম্য নয়। দেশের নির্বাচনী সহিংসতা যেন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সব নির্বাচনই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক এটাই সুনাগরিকদের চাওয়া ও প্রত্যাশা।নির্বিঘ্ন পরিবেশে নিশ্চিন্ত মনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদান করতে পারলে তা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করে। একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রতিপালনের মাধ্যমে যেমনি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়, তেমনি সমগ্র প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করে। অন্যথায় আস্থার সংকটের কারণে ভোটাররা ভোটদান থেকে বিমুখ হতে পারেন, কিন্তু সেটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য মোটেই কাম্য নয়। নিরপেক্ষ পরিবেশে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, রক্তপাতহীন নির্বাচন ও গণতন্ত্র চর্চার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচনী সংস্কৃতির অধঃপতনের কারণগুলো দূর করে কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনী সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে একটি সুষ্ঠ ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। বস্তুত সবাইকে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিতে হবে। তাই সামনের দিনগুলোয় অনুষ্ঠেয় স্থানীয় পর্যায়ের বাকি ধাপের নির্বাচনগুলো যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেদিকেও রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সবার প্রত্যাশা আমাদের দেশের পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ ও শতভাগ সহিংসতামুক্ত হোক।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরও পড়ুন