অবৈধ পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হোক
প্রকাশিত: ২১-১১-২০২১ দুপুর ২:৮
একটু সচেতন হলেই কমানো যায় পলিথিনের ব্যবহার, সেই সাথে বেঁচে যায় আমাদের পরিবেশ ও শতশত মানুষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর প্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যাবহার , উৎপাদন , বিপণন , এবং পরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে । সেই সাথে পলিথিন বাজারজাত করলে ৬ মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে । কিন্তু বর্তমানে বাজার গুলোতে প্রকাশ্যে ব্যাবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই ।
পলিথিন বর্তমান সময়ে অপরিহার্য উপাদান । প্রায় সব জায়গাতে পলিথিন ব্যাবহার করা হচ্ছে। পলিথিনে খাবার গ্রহণের ফলে মানবশরীরে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারের মত মরণঘাতী রোগের।বর্তমানে ছোট বড় সব ধরণের হোটেল বা রেঁস্তোরাতে দেখা যায় পলিথিন ব্যাগের ব্যাবহার।বিশোষজ্ঞদের মতে পলিথিনে গরম খাবার ঢালার সাথে সাথে বিসফেলন-এ তৈরি হয়। বিসফেলন-এ থাইরয়েড হরমনকে বাধা দেয়, বিকল হতে পারে লিভার ও কিডনি ।পলিথিন ব্যাগ বহন করা খাবার যদি কোনো গর্ভবতী নারী গ্রহণ করে তবে বিসলেন -এ গর্ভবতী নারীর রক্তের মাধ্যমে ভ্রূণে যায় ফলে ভ্রূণ নষ্ট হতে পারে এবং দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব । এবং সদ্যোজাত শিশুও বিকলাঙ্গ হতে পারে । আবার আমরা প্রায় সব ধরনের খাবার সংরক্ষণ করার জন্য পলিথিন ব্যাগে করে ফ্রিজে রেখে দেয় সেই খাবার গ্রহণ করলেও সমান ক্ষতি হতে থাকে ।
পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের পরে যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া হয় যার ফলে আমাদের আশেপাশে একটু লক্ষ করলেই দেখাযায় যেখানে সেখানে পড়ে আছে পলিথিনের পরিত্যাক্ত অংশ। ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্যেও পলিথিনব্যাগ ব্যাবহার করা হয়ে থাকে এবং এই পলিথিন গুলোই বিভিন্ন মাধ্যমে মাটির স্তরে প্রবেশ করে থাকে । পলিথিন যেহেতু অপচনশীল পদার্থ তাই এটি মাটির সাথে মিশে যায় না ।মাটিতে পলিথিন আটকে থাকার জন্যে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টিউপাদান চলাচলে বাঁধা দেয়। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না জমির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং শস্যের ফলন কম হয়। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সাথে ড্রেনে ঢুকে পড়ে যার ফেলে হালকা একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্ঠি হয় ।
পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যাক্ত অবিকৃত অংশ মাটি, পানি দূষিত করে । পলিথিন পোড়ালে অর্থাৎ পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে । পলিথিন জলাশয়ে ফেলার জন্য সেইটা মাছের মাধ্যমে আমার শরীরে প্রবেশ করছে এবং চর্মরোগ সহ মরণঘাতী ক্যান্সার হচ্ছে । পলিথিনের জন্যে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে ।পুরানো পলিথিন পুড়িয়ে অর্থ্যাৎ রিসাইকেল করে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি করা হচ্ছে যা পরিবেশের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর ।
দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হলেও সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী , ৫৫ মাইক্রন পুরুত্বের নিচে সব পলিথিন অবৈধ। তবে প্যাকেজিং এর কাজে ব্যবহারের জন্যে ৫৫ মাইক্রেন বেশি পলিথিন উৎপাদন করা যাবে। আর এইসুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ পিলিথিন উৎপাদন করছে । ২০০২ সালের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ৯৩১ টন পলিথিন জব্দ করা হয়েছে এবং ৫২ টি কারখানা উচ্ছেদ করা হয়েছে । ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ৪ টি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যাবহার করে ।সেহিসেবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ ১ বার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা ) বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে।
একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধনীর লালবাগ, কামরাঙ্গীচর এলাকায় প্লাস্টিকের কারখানা আছে প্রায় কয়েকশ। লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকাতে ঘুরে দেখা যায় পুরোটাই প্লাস্টিক উৎপাদের কারখানা। এখানে যেমন 'বৈধ ' পলিথিন উৎপাদিত হয় তেমনি অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি।
বাংলাদেশে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যাবহার বাড়াতে ১৭ টি পণ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহন পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কিন্তু পলিথিন সস্তা ও সহজেই পাওয়া যায় বলে জনসাধারণ পলিথিন ব্যাগ ব্যাবহার করে। যেহেতু এতদিন যাবৎ নিষিদ্ধ পলিথিন এর উৎপাদন হয়ে আসছে তাই হঠাৎ করে এটা বন্ধ করতে কিছুটা বেগ পেতে হবে । তাই আমাদের বিকল্প কিছুর কথা চিন্তা করতে হবে যেন পলিথিন ব্যবহার করার ফলেও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়। কম্পোস্টেবল পলিথিন হলো প্লাস্টিকের পরবর্তী আবিষ্কার যা নবায়নযোগ্য উপকরণ থেকে তৈরি করা হয় । এটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে মাটির সাথে মিশে যায় ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।
বর্তমানে ভারত, চীন ছড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বায়োডিগ্রেবল পলিথিন প্রস্তুত করা হচ্ছে । ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অৱস্থিত অভনী কোম্পানিটি বায়োডিগ্রেবল পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করে। আফ্রিকা, উগান্ডা, ইউরোপ,অস্ট্রেলিয়া , জার্মান, উত্তর আমেরিকাসহ প্রায় শতাধিক দেশে রাসায়নিক পলিথিনকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে এবং তারা পচনশীল পলিথিন উৎপাদন করছে । অন্যান্য দেশের সূত্রধরে আমাদের দেশে ও পচনশীল পলিব্যাগ প্রস্তুত করা হচ্ছে । ২০১৯ সাল থেকেই গাজীপুরের কামার পাড়াতে অবস্থিত " এক্সপো এক্সেসরিস " তে ভুট্টা থেকে পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুত করা হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ তবে এই পচনশীল পলিথিন রাষ্টীয়ভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন এটির ব্যবহার মাঝপথে থেমে না যায় এবং আবার নিষিদ্ধ পলিথিন ফিরে আসে ।
পলিথিন ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।যেহেতু আইন থাকা সত্বেও যখন পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা যাচ্ছে না তাই সচেতনতা ব্যাতিত নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না। পলিথিনের ক্ষতির দিকটি তাৎক্ষণিক ভাবে চোখে পড়ে না বিধায় এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে মানুষ অতটাও সচেতন না। যখন সাধারণ মানুষ পলিথিনের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে পারবে তখন তারা নিজ থেকেই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করবে না এবং বাজারে চাহিদা না থাকলে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও ধীরে ধীরে বন্ধ হবে ।
মানুষকে সচেতন ও কঠোরনির্দেশনার ফলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৯০ ভাগ লোক পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে কিন্তু আমাদের আমদের দেশে আইন প্রয়োগের অভাব নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন এখনো হচ্ছে ।নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে বিদ্যমান আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যেন কেউ পলিথিন উৎপাদন না করে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ বা ঠোঙা রয়েছে এই সব ব্যবহারে সচেতনতা ও সহজলভ্য করতে হবে। দেশে কোনোভাবেই যেন নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদিত না হয় সেদিকে সরকারকে করা নজর দিতে হবে এবং পিলিথিন ব্যাবহার বন্ধ করতে সারাদেশে ক্যাম্পেইন, মাইকিং, পোষ্টার, লিফলেট বিতরন করতে হবে। পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে তাই নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও ব্যাবহার বন্ধ করতে হবে।
লেখকঃ উম্মে কুলসুম কাইফাশিক্ষার্থী নৃবিজ্ঞান বিভাগজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়