গনপরিবহনে যৌন হয়রানি কি বন্ধ হবে না?

news paper

শানজানা রহমান

প্রকাশিত: ২৪-১১-২০২১ দুপুর ১:৫৫

8Views

সারাবিশ্ব যেখানে কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেখানে বাংলাদেশে এই মহামারির চেয়েও ভয়ংকর ও বর্বর মহামারি নারীর ওপর যৌন যৌন হয়রানি,নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। কয়েক বছর ধরেই ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।    
 
দেশে শিক্ষা ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তাঁদেরকে প্রতিদিনই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলে যেতে হয়। এ ছাড়াও নানা ধরনের প্রয়োজনে নারীদের ঘরের বাইরে বের হতে হয়। তাঁদের অনেকের যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনই ভরসা।কিন্তু এই গণপরিবহনে যাতায়াত করতে গিয়ে  প্রতিনিয়ত হেনস্তা ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশন এইডের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় শহরগুলোতে দিনে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানারকম হেনস্থার শিকার হন নারী যাত্রীদের একটা বড় অংশ। আর মাঝে মাঝে কিছু পুরুষ যাত্রীদের হয়রানি তো আছেই।বাস ড্রাইভার ও সহকারীরা তো  আছেনই, পাশাপাশি পুরুষ যাত্রীরাও কোনো না কোনো অজুহাতে  গায়ে স্পর্শ করেএ ধরনের অপকর্মে অংশ নিচ্ছেন। গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা নারীদের জন্য যে আর নিরাপদ নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যানেও বিষয়টি স্পষ্ট। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক বা অন্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।এছাড়াও ২০১৯ সালে গণপরিবহনে (সড়ক, রেল এবং নৌপথে) ৫২ ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌননির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। 
দেখা যাচ্ছে কোনো তরুণী বাসে একা হলেই তিনি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে শুভেচ্ছা পরিবহনের চলন্ত একটি বাসে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।ঐ মামলায় বাসচালক ও চালকের সহযোগীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে ফেলে দেয় বাসচালক ও চালকের সহকারী।ঐ একই বছরে ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে দুই বোনকে ধর্ষণ করে পাঁচ পরিবহনকর্মী।ঐ বছরের ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থেকে ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার হন এক পোশাককর্মী। পরে পুলিশ ওই বাসের তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে  বাসচালককে ঘটনাস্থল থেকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে জনগণ। একই বছরে টাঙ্গাইলের মধুপুর  এলাকায় চলন্ত বাসে এক তরুণীকে দল বেঁধে ধর্ষণের পর তাঁকে ঘাড় মটকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়ার ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।গত মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টা থেকে বকশি বাজার মোড় অবরোধ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে। অর্ধেক ভাড়া দেয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে গতকাল ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলে বাসের সহকারী। এর আগে, শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেয়া, বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে।গণপরিবহনে নারী যাত্রীর হয়রানির চিত্র নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়ত দেশের কোনো না কোনো স্থানে গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
নারীদেরকে আরো সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে । কোনো বাসে একা থাকলে তখন সামনের দিকে দরজার কাছের সিটে বসলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বোধ করবেন। বাংলাদেশে প্রায় সব বাসেই ড্রাইভারের পাশে বা পিছনে নারীদের সিট রাখা থাকে। তাই ড্রাইভার যদি নারীদের দিকে বারবার তাকান বা লুকিং গ্লাস দিয়ে বারবার দেখেন তাহলে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সন্ধ্যার পর বাস কোন রাস্তা দিয়ে যাবে, নারী হিসেবে সে বিষয়টি সবসময় মাথায় রাখবেন।যানবাহনে যৌন হয়রানির আতঙ্ক রুখতে বাসে জাতীয় জরুরি পরিসেবা নম্বর ৯৯৯ লিখে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। প্রয়োজনে নম্বর  ব্যবহার করবেন। 
 
গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।পরিবহন সেক্টরকে আরও উন্নত করতে হবে।গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গণপরিবহনের মালিক, শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনগুলো আন্তরিকভাবে এগিয়ে না এলে শুধু সরকার,আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এই মহামারী নিরাময় সম্ভব না। নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজকেও সোচ্চার হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ।
 
লেখকঃ শানজানা রহমান 
শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন