রক্তাক্ত সড়ক আর কতকাল?

news paper

শানজানা রহমান

প্রকাশিত: ২৮-১১-২০২১ দুপুর ৩:৯

8Views

বর্তমানে পত্রিকার পাতা ও টিভির পর্দায় আমরা প্রতিনিয়ত  দেখতে পাই সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র। দেশের কোনো না কোনো স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে।ঘরের বাইর বের হলেই আতঙ্কে থাকতে হয় নিরাপদে আবার ঘরে ফিরতে পারব কিনা।   
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে।  সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের  পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশেষ করে গত দুই দশকে মাথাপিছু সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি।কী ভয়ানক চিত্র!  
সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়।এটা দুর্যোগের পর্যায়ে চলে গেছে।  
২০১১ সালে  চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারা নিহত হন।২০১৭ সালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে একটি সংগঠনের তথ্যানুসারে-সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৫ জনের।২০১৮ সালে  সারাদেশে ৩ হাজার ১০৩ সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৪ হাজার ৪৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।রোডটি সেফটি ফাউন্ডেশনের 'সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০' এ বলা হয়েছে- দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন ।সম্প্রতি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুধু অক্টোবর মাসেই ৩১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩৮৩ জন এবং আহত হয়েছেন ৬৯৪ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৮ জন নারী ও ৪১টি শিশু। তারা আরও বলেছে, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উভয়ই বেড়েছে। যেখানে সেপ্টেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২৭৩টি এবং নিহত হয়েছিলেন ৩০৪ জন। ২০১৮ সালে  ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং একটি বাস থামলে সেটাতে ওঠার চেষ্টা করে। সেসময় জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস বেশি-যাত্রী-পাওয়ার-জন্যে প্রতিযোগিতা করতে করতে অতিরিক্ত গতিতে এগিয়ে আসে, তার মধ্যে একটি বাস বেপরোয়াভাবে প্রথম বাসের পাশে ফুটপাথে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায়, তাতে ২ শিক্ষার্থী নিহত এবং আরো ১২ জন গুরুতর আহত হয়।এ ঘটনার পর সারাদেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে সড়কে অবস্থান, মানববন্ধন ও অবরোধের মাধ্যমে তাদের বিক্ষোভ জানান দিতে থাকে। "উই ওয়ান্ট জাস্টিস", "আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাহিরে" প্রভৃতি স্লোগানে ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা সড়ক মুখরিত করে রাখে।পুলিশ পরে বাস তিনটির চালক, সহকারী এবং ঘাতক-বাসের মালিককে গ্রেপ্তার করে।
সম্প্রতি ঘাতক ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সতীর্থদের আন্দোলন আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিল যে সড়ক মোটেই নিরাপদ নয়।  গত ২৪ নভেম্বর,২০২১ বেলা ১১টা ২০ মিনিটে পল্টন মডেল থানার গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ার গোল চত্বরের দক্ষিণ পাশে নটরডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান (১৮) রাস্তা পার হওয়ার সময়  ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ি বেপরোয়া গতিতে নাঈমকে ধাক্কা দেয়।এরপর নাঈমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেওয়ার পর জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে দুপুর পৌনে ১২টায় মৃত ঘোষণা করেন। 
দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার টহল পুলিশ ও পথচারীরা ময়লার গাড়িচালক  ও গাড়ির ভেতরে থাকা পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে  আটক করে।তার ঠিক একদিন পরই বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টো দিকে আহসান কবিরকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ি।   
বাংলাদেশের সড়কে এমন সব করুণ কঠিন ট্র্যাজেডির জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন।২০১১ থেকে ২০২০ সাল হচ্ছে জাতিসংঘ ঘোষিত সড়ক নিরাপত্তা দশক। আর এই দশ বছরের মধ্যে সদস্য দেশগুলো সড়ক দুর্ঘটনা হতাহতের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার কথা থাকলেও বাংলাদেশে এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগও মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নামক মানব সৃষ্ট  দুর্যোগ কি কিছুতেই মোকাবিলা করা যায় না?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে; ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।পুলিশ রিপোর্টেও বেশির ভাগ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে অতিরিক্ত গতি এবং চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো।  
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,বিপজ্জনক ওভারটেক,বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, অদক্ষ ও মাদকাসক্ত চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাট নির্মাণে ত্রুটি, পথচারী-সেতু ব্যবহার না করা, ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। দুর্ঘটনার এত সব কারণ জানা থাকা সত্ত্বেও সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলো না কেন?
 
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে জনসচেতনতা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। 
ফিটনেস ও সার্টিফিকেটবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো থেকে বিরত থাকা,Blind Point (যে জায়গাগুলি চালক দেখতে পান না) সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে, সামনের গাড়ির সঙ্গে ৪ সেকেন্ড সময় ব্যবধান রাখতে হবে, যাতে সামনের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলেও গাড়ি থামানোর সময় পাওয়া যায়,গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকের কথা বলা থেকে বিরত থাকা,অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন এর ক্ষেত্রে সচেতন থাকা,নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকা,ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ করা।তাহলেই সড়কে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা  সম্ভব হবে। 
 
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাদের সহপাঠীকে হারানোর পর একটি দাবি তুলেছে– ‘সড়কে মানুষ তো দূরের কথা, একটি প্রাণী বা পাখির মৃতদেহ দেখতে চাই না। মানুষের মতো তাদেরও স্বজন আছে অনুভূতি আছে’– এই দাবি হতে হবে আমাদের সকলের। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষের দায়িত্ব নয়। প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ।  সরকার, নীতিনির্ধারক, পুলিশ, গণমাধ্যম, ব্যক্তিপর্যায়সহ সব পক্ষেরই এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। সব পক্ষের সচেতনতা, জনসচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগই পারে সড়কে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে।
 
লেখকঃ শানজানা রহমান 
শিক্ষার্থীঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন