শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন

news paper

ইউছুব ওসমান, জবি

প্রকাশিত: ৬-১-২০২২ দুপুর ৩:৩৪

85Views

ঘন কুয়াশায় মোড়ানো শীতের সকাল! চোখ বুজলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এক অপরূপ দৃশ্য। কনকনে শীতে জুবুথুবু একটি গ্রামের ভোর। কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতির কোলে বইছে হিমেল হাওয়া। কিষাণ বাড়ির উঠোনের একপ্রান্তে গনগনে জ্বলন্ত উনুন। সে আগুনের আঁচে উনুনের ধার ঘেষে বসে আছে বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলে। চলছে হাসিখুশি কিষাণীর সুনিপুণ হাতের কাজ। জ্বলন্ত উনুনের উপরে ঢাকনায় ঢাকা হাড়ি। একরতি কাপড়ের ভাজে ভাজে উঠছে আতপ চালের গুড়ো, নতুন খেঁজুর গুড় আর নারকেল কোরা দেওয়া ছোট বাটি। কিষাণীর হাতের কারুকার্য ফুটে উঠছে ক্ষণেক্ষণে। একটু পরপরই নামছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা।একেকবার একেকজনের পাতে চলে যাচ্ছে সুস্বাদু এই খাবার। এ ছবি পরম মমতার, স্নেহ ও ভালোবাসার এবং পারিবারিক অটুট বন্ধনের এক চিরায়ত গ্রামবাংলার চিরচেনা শীতকালীন ছবি।
 
মোড়ের টং দোকানে ভোর হতেই জমতে থাকে জটলা। অনেকের গায়ে চাপানো থাকে সাধ্যমতো শীতের চাদর। কেউ বা সোয়েটার পরে মাথায় বাঁধে মাফলার, কিংবা দিন এনে দিন খাওয়া গরীব মনু মিয়ার গায়ে জড়ানো থাকে ছেঁড়া একটি কাঁথা। গল্পে গল্পে একের পর এক চায়ের কাপ খালি হয়ে যায়। অতিশয় বৃদ্ধ কদম আলী চাদরের খোলস থেকে মাথা বের করে হাঁক ছাড়ে, 'আমাকেও এক কাপ চা দাও রমজান মিয়া। এই শীতে এক কাপ গরম চা না হলে আড্ডা জমেনা।' চিরাচরিত গ্রাম-বাংলার এই তো শীত ঋতু!
 
শীতকালের গ্রাম যেন এক অপরূপ মহিমায় ভরপুর থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এনে দেয় এক অনন্য মাত্রা। কুয়াশায় আচ্ছন্ন শীতের সকাল! মুখ খুললেই ধোঁয়া বের হওয়া দেখে অবাক হয়ে যাওয়া। বাড়িতে বাড়িতে চলে পিঠা উৎসব। ভাপা, চিতুই, পাটিসাপটা, পুলি, কুলি নানান ধরনের পিঠা। 
 
শীতের অলস সকাল রচনা করে রোজকার রূপকথা। ঘুম ভাঙ্গলেও বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায়না। সযতনে তুলে রাখা লেপ, কাঁথা, কম্বলের সে এক দারুণ মজা। কুয়াশার বুক চিরে বেরিয়ে আসা সোনালী রোদে দেওয়া ওম। তুলোর ফাঁকে ঢুকে থাকা মিষ্টি রোদের গন্ধ। সন্ধ্যার আকাশে দিগন্ত জুড়ে সারি বেঁধে উড়ে চলা অতিথি পাখির দল। কিচির-মিচির শব্দ শীতের প্রকৃতিকে করে তুলে অনন্য।
 
ব্যাস্ততায় ভরা নগর জীবনে শীতের আবেদন আলাদা হলেও গ্রামে যেনো প্রতিটি পদক্ষেপে আলাদা করে অনুভব করা যায় শীত ঋতুর তাৎপর্য্য। বাংলার পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে তাকালেই চোখে পড়ে খেজুর  গাছের আগায় ঝুলছে ছোট্ট রসের হাড়ি। কোথাও গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন গাছিরা। আর ফসলের মাঠজুড়ে সোনালি আভায় সকাল সন্ধ্যা জমে হিম হিম কুয়াশা। শীতে জ্বাল দেওয়া গরম রস বা কাঁচা রস দুই এর স্বাদই অতুলনীয়! আর রসে ভেজানো রসের পিঠার তো কোনো জুড়িই নেই। 
 
গ্রাম ও শহরের হাঁট-বাজার গুলোতে বসে নানান রকমের সবজির পসরা।  ডালায় ডালায় সাজানো থাকে শীতের সবজি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, শালগম, ওলকপি, গাজর, টমেটো। অতুলনীয় স্বাদে ভরপুর এসব সবজি চোখ জুড়ায়, মন ভরায়।
 
শুস্ক এ ঋতুতে এ সময়টা শুকিয়ে আসে খাল বিলের পানি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও বা নদীর বুক চিরে চর জাগে। আর তাতে গ্রামের দূরন্ত কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে অল্প পানিতে মাছ ধরার উৎসবে। হিমশীতল পানিতে মাছ ধরার এই উৎসব যেন দুপুরের বুকে নামিয়ে আমে এক অন্যরকম সৌন্দর্য্য। খাল-বিলের বুকে খাবারের খোঁজে খাল-বিল আর মাঠে-ঘাটে ঝাঁকে ঝাঁকে নামে সাদা বকের ঝাঁক। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদাফুলের মত বসে থাকা বকের শুভ্রতা সেও এক অপরূপা দৃশ্য।
 
শীতের আরেক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য বিরাজ করে সুবিশাল মাঠ দখল করে থাকা সরিষা ক্ষেতে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে ফুটে থাকা হলুদ সরিষার ফুল যেন বিছিয়ে রাখে হলুদ ফুলেল চাদর। আর সেই ফুলকলিদের উপর উড়ে চলা রঙিন প্রজাপতি আর মৌমাছিদের মেলা মন হরন করে প্রতিনিয়ত।
 
শীতের ভোরে ফিনফিনে পাতলা ধূসর কুয়াশা নামে আঙিনায়। প্রাকৃতিক মসলিনের সে নেকাব সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে হলুদ গাঁদার দল, গুটিসুটি মেরে শিশিরে ভিজছে চন্দ্রমল্লিকারা। আর ডালিয়া? ঋজু গ্রীবায় মাথা দুলিয়ে সগর্বে যেন বলছে সে—ওঠো, জেগে ওঠো সব ফুল। ভোরের সূর্য তোমাদের ডাকছে। সারা গায়ে শিশিরের মুক্তো মেখে তোমরা চমকে দাও এ পৃথিবীর মানুষদের। ক্লান্তি, হতাশা, বেদনা, কষ্ট—মানুষের সব নীল ব্যথা তোমরা ঢেকে দাও আজ তোমাদের রঙে। শিমুলের ডালে নব উদ্যমে উঁকি দেয় লাল টুকটুকে শিমুল ফুল। রক্ত পলাশেরা ফাগুনের জানান দিতে থাকে তাদের অপার সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে। প্রকৃতি সাজে এক অপরূপ সাজে।

আরও পড়ুন