ধন্যবাদ সৈয়দ আবুল হোসেন

পদ্মা সেতু দক্ষিণ বঙ্গের মানুষকে মুক্তি দিয়েছে

news paper

শামীম আহমদ

প্রকাশিত: ১-৬-২০২২ রাত ৯:২৬

8Views

এই পৃথিবীতে পরিলক্ষিত সকল মানুষ তা নয় যা আমরা ওদের গণ্য করি, কিছু সময়ের জন্য এরা শরীরে বসবাস করছে মাত্র। একদিন এদের শরীরের মৃত্যু হবে সত্যি, কিন্তু এরা সবাই অমর। সে পুনরায় নতুন শরীর ধারন করবে। সৈয়দ আবুল হোসেন তেমনি একজন মানুষ যার শরীরের মৃত্যু হলেও পুনরায় নতুন শরীর ধারন করে তিনি আমার স্মৃতিতে অমর থাকবেন। জীবিত অবস্থায় আমরা মানুষের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ভুলে যাই। অনেক সময় জীবিত পিতামাতার গুরুত্ব দিতেও যেভাবে সন্তানেরা ভুলে যায়। তাই সময়ের সাথে সাথে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে থাকে। তেমনি গুরুত্বের পরিবর্তন হয় ঋতু পরিবর্তনের মতোই। সময় কখনও মানুষের নির্দেশিত পথে চলে না, মানুষকে সময়ের নির্দেশিত পথে চলতে হয়। আবুল হোসেনের মতো সৎ এবং যোগ্য মানুষ বার বার জন্ম হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে এই, যে বস্তু সহজেই লাভ করা যায়, সে বস্তুর প্রতি মানুষের মূল্যবোধ থাকে না। অধিকতর আত্মা নিজের দেহকেই সব কিছু বলে গণ্য করে, স্বয়ং দেহ থেকে যে ভিন্ন তা জানতেই পারে না শরীরের যে দুঃখ, সুখ, স্বাদ। গন্ধ আদির অনুভব হয় তাকেই নিজের অনুভব মেনে নেয়। আজ এটা আমিও মেনে নিতে পারি। পদ্মা সেতু সৈয়দ আবুল হোসেনের নিজের একটি অঙ্গ। বিশ্ব ব্যাংক নিজে থেকে কিছুই করেনি। আমাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থ এর মূলে কাজ করছে। শেখ হাসিনা নিজের মুখেই সেই ষড়যন্ত্রকারিদের মধ্যে দুজনার নাম উল্লেখ করছেন। একজন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনুস অন্য একজন ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। আসলে স্বার্থ আমাদের ইচ্ছেগুলিকে শেষপরিণাম পর্যন্ত যেতে দেয় না। তাকে পুরাপুরি ছেড়ে দিতে চায় না। আমাদের ইচ্ছেগুলো যা-কিছু নিজের মধ্যে আটকিয়ে রাখি, তা জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। মঙ্গলকর্মে যখন তারা একেবারে মুক্তিলাভ করে তখনই তাদের বিকার ঘুচে যায়। তখনই তারা স্বাভাবিক হয়ে উঠে। আমাদের প্রবৃত্তির সত্য পরিণাম সেইখানে। আনন্দেরও পথ সেই দিকে। 
 
নিজের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে হঠাৎ সংশয়হীনতা অনুভব করবার যে পরিতৃপ্তি তাকে অহংকার বলা ঠিক না। ছেলের প্রতি মা-বাপের প্রথম যে আনন্দ সে ছেলে সুন্দর বলে নয়, ছেলে যথার্থ নিজের বলেই সেই আনন্দ হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের গুণ স্মরণ করে তাঁরা গর্ব অনুভব করতে পারেন, কিন্তু সে আর-একটা জিনিস। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক "পদ্মা সেতু" আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেই সঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেনের সততা প্রভাতের আলোকে পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই অর্জন নিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন গর্ব করতে পারেন। সমগ্র বাঙালির আনন্দ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু কেবল আমাদের বলেই আমরা এতো আনন্দ উপভোগ করছি। এই অর্জন আমাদের আনন্দের গতি পদ্মা নদীর স্রোতের মতোই বাড়িয়ে দিয়েছেন। নদী যেমন কাটাখালের মতো সিধা চলে না, আঁকিয়া বাঁকিয়া নানা মূর্তি ধারণ করে চলতে থাকে, আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন তেমনি আঁকা বাঁকা চলছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, মানবতার ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস, দেশপ্রেমের ইতিহাস লেখার মধ্যে এই সময়টাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। ইতিহাসের ভেতর দিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আসলে ইতিহাসের ভিতর দিয়ে মানুষ নিজের হৃদয়কে ভাষায় প্রকাশ করতে চেষ্টা করে; সেই হৃদয়ের কোনো অবস্থার কোনো পরিচয় যদি কোনো লেখায় ব্যক্ত হয় তবে মানুষ তাকে কুড়িয়ে রেখে দেয়। ব্যক্ত যদি না হয় তবেই তাকে ফেলে দেয়। অতএব হৃদয়ের অব্যক্ত আকূতিকে ব্যক্ত করায় পাপ নাই।
 
মানুষের মধ্যে একটা দ্বৈত আছে। বাংলাদেশের কল্যাণ বাঙালিরাই চায় না। পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান থাকলেও এদেশের আংশিক নাগরিকরা এর বিরুদ্ধে যাবে তা ভাবতে পারিনি। বাহিরের ঘটনা, বাহিরের জীবনের সমস্ত চিন্তা ও আবেগের গভীর অন্তরালে যে মানুষটা বসে আছে, তাহাকে ভালো করে চিনি না ও ভুলে থাকি, কিন্তু জীবনের মধ্যে তাহার সত্তাকে তো লোপ করতে পারি না। বাইরের সঙ্গে তার অন্তরের সুর যখন মেলে না- সামঞ্জস্য যখন সুন্দর ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠে না তখন সেই অন্তরনিবাসীর পীড়ার বেদনায় মানসপ্রকৃতি ব্যথিত হতে থাকে। এই বেদনাকে কোনো বিশেষ নাম দিতে পারি না- ইহার বর্ণনা নেই- এইজন্য এর যে রোদনের ভাষা তা স্পষ্ট ভাষা নয়, তার মধ্যে অর্থবদ্ধ কথার চেয়ে অর্থহীন সুরের অংশই বেশি। জীবনে একটা বয়স আসে যখন মানুষের সম্বন্ধে আর নূতন প্রত্যাশা করবার কিছুই থাকে না; তখন সে যেন আমাদের কাছে একরকম ফুরিয়ে আসে। সেরকম অবস্থায় তাঁকে দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার চলতে পারে কিন্তু উৎসব চলতে পারে না; কারণ, উৎসব জিনিসটাই হচ্ছে নবীনতার উপলব্ধি- তা আমাদের প্রতিদিনের অতীত। পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা আজ উৎস করি। উৎসব হচ্ছে জীবনের কবিত্ব, যেখানে রস সেইখানেই তার প্রকাশ।
 
জগতে আমরা অনেক জিনিসকে চোখের দেখা করে দেখি, কানের শোনা করে শুনি, ব্যবহারের পাওয়া করে পাই; কিন্তু অতি অল্প জিনিসকেই আপন করে পাই। আপন করে পাওয়াতেই আমাদের আনন্দ। তাতেই আমরা আপনাকে বহুগুণ করে পাই। পৃথিবীতে অসংখ্য লোক; তারা আমাদের চারিদিকেই আছে কিন্তু তাদের আমরা পাই নি, তারা আমাদের আপন নয়, তাই তাদের মধ্যে আমাদের আনন্দ নেই। সৈয়দ আবুল হোসেনের সততার ইতিহাস আজ আমাকে আনন্দ দেয়, শিক্ষাও দেয়। যে কারনে সমস্ত জনগণের হৃদয়ে আবুল হোসেনকে আপন করে পেয়েছে। আসলে আপন করে পাওয়াই হচ্ছে একমাত্র লাভ, তার জন্যেই মানুষের যত কিছু সাধনা। যেখানেই এই আপন করে পাওয়া আছে, সেইখানেই উৎসব। ঘর সাজিয়ে বাঁশি বাজিয়ে সেই পাওয়াটিকে মানুষ সুন্দর করে তুলে প্রকাশ করতে চায়। বিবাহেও পরকে যখন চিরদিনের মতো আপন করে পাওয়া যায়, তখনো এই সাজসজ্জা, এই গীতবাদ্য। ‘তুমি আমার আপন’ এই কথাটি মানুষ প্রতিদিনের সুরে বলতে পারে না— এতে সৌন্দর্যের সুর ঢেলে দিতে হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আবুল হোসেন তার সমস্তটাই উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন। শিশুর প্রথম জন্মে যেদিন তার আত্মীয়েরা আনন্দধ্বনিতে বলেছিল ‘তোমাকে আমরা পেয়েছি’— সেইদিনে ফিরে ফিরে বৎসরে বৎসরে তারা ঐ একই কথা আওড়াতে চায় যে, ‘তোমাকে আমরা পেয়েছি। তোমাকে পাওয়ায় আমাদের সৌভাগ্য, তোমাকে পাওয়ায় আমাদের আনন্দ, কেননা তুমি যে আমাদের আপন, তোমাকে পাওয়াতে আমরা আপনাকে অধিক করে পেয়েছি। এই জীবনে মানুষের যে কেবল একবার জন্ম হয়, তা বলতে পারি নে। বীজকে মরে অঙ্কুর হতে হয়, অঙ্কুরকে মরে গাছ হতে হয়- তেমনি মানুষকে বার বার মরে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে হয়। আমি স্বপ্ন দেখি শিগগিরই আবুল হোসেন নতুন জীবনে প্রবেশ করবেন। সেই পূর্বজীবনের মধ্যে আজকের এই নবজন্মের সম্ভাবনা এতই সম্পূর্ণ গোপনে ছিল যে, তা কল্পনারও গোচর হতে পারত না। বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক লোকের কি এমন স্বার্থ ছিলো পদ্মা সেতু না হওয়াতে! কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম এই উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধেই ছিলো। এখন চলতে গিয়ে যদি তাদের চলার পথে পদ্মা সেতু সম্মুখে পরে তবে কি তারা পদ্মা সেতুতে উঠবে না?
 
মানুষের মধ্যে দ্বিজত্ব আছে; মানুষ একবার জন্মায় গর্ভের মধ্যে, আবার জন্মায় মুক্ত পৃথিবীতে। তেমনি আর-একদিক দিয়ে মানুষের এক জন্ম আপনাকে নিয়ে, আর-এক জন্ম সকলকে নিয়ে। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে তবে মানুষের জন্মের সমাপ্তি, তেমনি স্বার্থের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে মঙ্গলের মধ্যে উত্তীর্ণ হওয়া মনুষ্যত্বের সমাপ্তি। বাইরের দিক থেকে এ যেমন, অন্তরের দিক থেকেও দ্বিতীয় জন্মের সেইরকমের একটি ক্রমবিকাশ আছে। ঈশ্বর যখন স্বার্থের জীবন থেকে আমাদের মঙ্গলের জীবনে এনে উপস্থিত করেন, তখন আমরা একেবারেই পূর্ণ শক্তিতে সেই জীবনের অধিকার লাভ করতে পারি নি। ভ্রূণত্বের জড়তা আমরা একেবারেই কাটিয়ে উঠি নি। তখন আমরা চলতে চাই, কারণ চারি দিকে চলার ক্ষেত্র অবাধ- বিস্তৃত- কিন্তু চলতে পারি নি, কেননা আমাদের শক্তি অপরিণত। এই হচ্ছে দ্বন্দ্বের অবস্থা। শিশুর মতো চলতে গিয়ে বার বার পড়তে হয় এবং আঘাত পেতে হয়; যতটা চলি তার চেয়ে পড়ি অনেক বেশি। তবুও ওঠা ও পড়ার এই সুকঠোর বিরোধের মধ্য দিয়েই মঙ্গললোকে আমাদের মুক্তির অধিকার ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে। পদ্মা সেতু দক্ষিণ বঙ্গের মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার পরিধি অধিক প্রশস্ত হয়েছে। ধন্যবাদ সৈয়দ আবুল হোসেন। 

আরও পড়ুন