সৈয়দ আবুল হোসেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক

news paper

শামীম আহমদ

প্রকাশিত: ২-৬-২০২২ দুপুর ১২:৫৬

18Views

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব দুটি কারণে। এর একটি হলো ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যটি বুদ্ধিবৃত্তিক গুণ। ঐশ্বর্যের চেয়ে দামি সম্পদ বুদ্ধিমত্তা। সব চেয়ে বড় দারিদ্র হচ্ছে মূর্খতা। নিরর্থক ভয় পাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সবচেয়ে অধিক মূল্যবান বিষয় হৃদয়বান হওয়া। বহু বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, সহজাতভাবেই মানুষের মাঝে দুটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য থাকে। সেগুলোর একটি হলো জীববৃত্তি, যা মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করে। অন্যটি হলো বুদ্ধিবৃত্তি, যা ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করে। মানবহৃদয়ে জীববৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। জীববৃত্তি বৈশিষ্ট্যটি সহজাতভাবেই শক্তিশালী হওয়ায় সেটি বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষের একটি বড় সুবিধা হলো, তার ভাষার দক্ষতা। এ ভাষার দক্ষতা বুদ্ধিবৃত্তি বৈশিষ্ট্যকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে; যার কারণে মানুষ জীববৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। মানুষের মাঝে যে পশুত্ব থাকে, সেটির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তি। ভাষার ক্ষেত্রে শব্দ চয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাকে মার্জিত ও শালীন করার জন্য মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হয়। সুন্দর এবং মার্জিত ভাষা সভ্য মানুষের পরিচায়ক। যারা সমাজকে নেতৃত্ব দেয়, তাদের ভাষা-জ্ঞান এক অনন্যতায় সমৃদ্ধ হতে হয়। একজন নেতা তার সুন্দর এবং সাবলীল ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো দার্শনিক রাজার ধারণা দিয়েছিলেন। একজন দার্শনিক রাজা হবে প্রজ্ঞালব্ধ এবং বাকপটু। বাকপটু হওয়ার জন্য একজন নেতাকে তার ভাষার দক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হয়। কুরুচিপূর্ণ এবং নোংরা ভাষা যাযাবর বা অসভ্য সমাজে চলতে পারে; কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ যখন কুরুচিপূর্ণ ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন সে সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। ভাষার সঙ্গে মানুষের চরিত্রের একটি অন্তঃমিল সব সময় থাকে। ভাষা প্রয়োগে শব্দ চয়নের ব্যবহার একজন মানুষের ব্যক্তিত্বকে নির্দেশ করে।
 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যারা বিশ্বাস করে, তারা কখনোই নীতিবিবর্জিত হতে পারে না। একজন নেতার কী ধরনের গুণাবলি থাকা উচিত, সেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন প্রমাণ করে। দোষে-গুণে মিলেই মানুষ। কোনো মানুষই নিখুঁত নয়। তবে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ন্যূনতম সৌজন্যবোধ ও পরিমিতিবোধ থাকা উচিত। একজন নেতার প্রধান গুণ হলো তার নৈতিক চরিত্র। তারপর অন্যান্য গুণের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ক্ষমতার দম্ভ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। একজন নেতাকে স্বল্পভাষী হতে হয়। তার প্রতিটি কথা হওয়া উচিত ব্যক্তিত্বপূর্ণ। অশালীন বা অসংলগ্ন কথাবার্তা একজন নেতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। একজন নেতাকে বহু মানুষ অনুসরণ করে। তাই নেতার আদর্শ হবে শিক্ষণীয়। মুখের কথা একটি শিল্প। এ শিল্পের সঠিক চর্চাই পারে আমাদের সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতে। পশ্চিমের লোকেরা বলে, তাদের সমস্ত জ্ঞানভান্ডারের আঁতুড়ঘর ছিল প্রাচীন গ্রিস। পুর্বের লোকেরাও অস্বীকার করে না, তাদের মননেও গ্রিক মনীষার প্রভাব সুগভীর। পুর্ব-পশ্চিম উভয়ের চিন্তাজগৎকে প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে প্রভাবিত করে চলেছে যে গ্রিক দর্শন, তার প্রায় অর্ধেকটা রূপায়িত হয়েছে প্লেটোর হাতে। প্লেটো পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থকার, যাঁর প্রায় ৩৫টি গ্রন্থ আমাদের কাল পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেগুলো একেকটা মণিরত্ন; সেই রত্নভান্ডারের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নটির নাম দ্য রিপাবলিক। প্লেটোর সব লেখাই সংলাপ। রিপাবলিক তাঁর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংলাপ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮০-৩৮২ সালের দিকে লেখা। সক্রেটিস নামে এক ব্যক্তির মুখে বর্ণিত এ সংলাপের প্রধান চরিত্র প্লেটোর গুরু সেই সক্রেটিসই, যিনি এথেন্সের যুবসমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে হ্যামলক পান করেছিলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে দ্য রিপাবলিক প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। এ গ্রন্থকে রাসেল তিনটি অংশে মোটা দাগে ভাগ করেন। প্রথম অংশে আছে একটি আইডিয়াল কমনওয়েলথ বা আদর্শ রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে আলোচনা। সেসব আলোচনার অন্যতম উপসংহার: শাসকেরা অবশ্যই হবেন দার্শনিক। দ্বিতীয় অংশের আলোচনার বিষয় দার্শনিক কে? কীভাবে একজন মানুষ দার্শনিক হয়? শুভ, ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞান, ধারণা বা অভিমত, সত্তা, অবভাস ইত্যাদি বিষয় অংশের আলোচ্য। তৃতীয় অংশে আছে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে প্রচলিত শাসনতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ও সেগুলোর দোষগুণ বিচার। রিপাবলিকে প্লেটোনিক সক্রেটিসের সংলাপ চলে এথেন্স ও এথেন্সের বাইরের কজন ব্যক্তির সঙ্গে। আদর্শিক ও বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে জাস্টিস বা ন্যায়ের স্বরূপ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষে সক্রেটিসের বয়ানে প্লেটো এমন এক ন্যায়পর রাষ্ট্রের কল্পনা হাজির করেন, যার শাসকেরা হবেন দার্শনিক। আমার মনে হয়, ‘যতক্ষণ না দার্শনিকেরা রাজা হচ্ছেন বা জগতের রাজা ও রাজপুত্রগণ দার্শনিক চেতনা ও দার্শনিক শক্তির অধিকারী হচ্ছেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞার মিলন ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নগররাষ্ট্রগুলো অমঙ্গলের হাত থেকে রেহাই পাবে না, মানবজাতিও মুক্তি পাবে না বলে আমার বিশ্বাস।
 
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকেরা বিভক্ত থাকবে তিনটি শ্রেণীতে: জনসাধারণ, সৈন্যবাহিনী ও অভিভাবকমণ্ডলী। এমন বিশ্বাস সৃষ্টি করা হবে যে ঈশ্বর তিন প্রকারের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সর্বোত্তম তারা সোনার তৈরি, দ্বিতীয় সারির লোকেরা রুপার, আর সাধারণ জনতা পিতল ও লোহার তৈরি। সোনার তৈরি লোকেরা হবে অভিভাবক, রুপার তৈরি লোকেরা হবে সৈনিক আর অবশিষ্টদের করতে হবে কায়িক পরিশ্রম। জাস্টিস বা ন্যায়পরায়ণতা বলতে বোঝাবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ কাজ সম্পাদন করা। কার কী কাজ বা পেশা, তা নির্ধারণ করে দেবে সরকার। রিপাবলিকে একটি রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থার প্রায় সব ক্ষেত্র নিয়ে প্লেটোর প্রস্তাবনা আছে: আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও স্বরূপ কী হবে, কেমন হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। প্রথম ভাববাদী দার্শনিক হিসেবে প্লেটোর পরিচয় যে কারণে, সেই ভাবতত্ত্ব বা থিওরি অব আইডিয়াস তিনি হাজির করেছেন এই গ্রন্থে বিশদভাবে। রাজনীতি ও জীবনকে দর্শনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা ছাড়াও দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে আছে ধর্ম, অমরত্ব, বিজ্ঞান, নাটক, কাব্যকলা ইত্যাদি নিয়ে প্লেটোর ভাবনা। অনেককেই বলেন- ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো৷‘ আমরা চট করে লিখি বটে৷ কিন্তু প্রায় কেউই মন থেকে বিশ্বাস করি না৷ ভিন্নমত মানেই আমাদের কাছে অপরাধ৷ আমরা শুধু সহমত সহ্য করি, ভিন্নমত নয়৷ ভিন্নমতের জন্য জীবন দেয়া তো দূরের কথা, সুযোগ থাকলে ভিন্নমতের জীবন নিতে চাই আমরা৷ স্যামুয়েল জনসন বলেছেন, ‘দেশপ্রেম পাজি লোকের শেষ অবলম্বন।’ বক্তব্যটির মূল্যায়ন করা যাক, যদি স্যামুয়েল জনসনের বক্তব্যকে আক্ষরিক সত্য হিসেবে ধরে নেই, তবে জর্জ ওয়াশিংটন, চার্চিল, লিঙ্কন, গান্ধী, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ভাসানী সকলেই দুষ্টলোক ছিলেন। অথচ, বাস্তবতাই প্রমাণ করে যে, এরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং সুযোগসন্ধানী ছিলেন না।
 
আমার দেশ তোমার দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে মূলত দেশপ্রেম প্রকাশ করাটা জরুরি নয়। এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও বিকৃত অভিব্যক্তি। যে দেশপ্রেম অন্য জাতিকে হেয় করে তা উৎকট স্বাদেশিকতা এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। জাপানিদের উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তাদের দেশপ্রেম জাতীয় অহংকারে পরিণত হয়েছে। মানসম্মত পণ্য এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জাপানি দেশপ্রেমের নিদর্শন।
রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় তার প্রতি মানুষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ। বাংলাদেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা; প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা এই টাকাওয়ালাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করে পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন; তৈরি করলেন অগণিত নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্খী, কিন্তু দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে নেয়। এমনকি কোনো দোষ ছাড়া, কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া শুধু টাকার জোরে কেন্দ্র থেকে একজন রাজনীতিবিদকে বহিষ্কার পর্যন্ত করতে সমর্থ্য হন ওই ব্যবসায়ী এবং টাকাওয়ালারা। কী আশ্চার্যের ব্যাপার! রাজনীতির নামে এখানে এই নীতিই চর্চা ও লালন করেন দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত! তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! এটিই বতর্মানে বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনীতির চেহারা। এখানে প্রতিষ্ঠিত ও তারকা রাজনীতিবিদরা আজ পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন; রাষ্ট্রীয় কোনো নীতিনিধার্রণী কাজে তাদের মূল্যবান মেধা ব্যয়িত হচ্ছে না, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে তারা উপদেশ ফিকির করে বেড়াচ্ছেন। এই যদি হয় রাজনীতির চেহারা, তাহলে এ রাজনীতি মানুষের কল্যাণ করবে কী করে? এ রাজনীতি তো মানুষের কোনো উপকারে আসছে না! হাজার কোটি, লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেও মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না! মানুষের সামনে শুধু সমস্যার পাহাড় তৈরি হচ্ছে! যিনি রাজনীতিতে টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি তো ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়েই তা করেন, জনসেবা তো তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; তিনি তো নেতা নন, সাধারণ মানুষের কাছে তার তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এ প্রতিফলন কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণে ঘটলেই চলবে না, প্রতিটি নাগরিক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে একজন অতিথি আপ্যায়নে কিংবা নিজ প্রবাসে অবস্থানকালীনও একই আচরণ বজায় রাখতে হবে। দেশীয় অহংকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় করাকে অবাস্তব দেশপ্রেম বলা হয়। প্রত্যেক দেশে দুই ধরনের নাগরিক বাস করে, দেশপ্রেমিক ও প্রতারক; যারা ক্রমানুসারে সম্পদ ও দায়। দেশপ্রেমিক দু’প্রকার। যথা সময়সাপেক্ষ দেশপ্রেমিক, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। সময়সাপেক্ষ দেশপ্রেমিকরা ব্যক্তির ঊর্ধ্বে জাতির স্থানের কথা প্রচার করে। একজন সুযোগসন্ধানী দেশপ্রেমিক বলে, ‘জাতির জন্য যতটুকু প্রয়োজন আমি করব।’ এটি কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, বরং মৌখিক বক্তব্য। সময়োচিত দেশপ্রেমিকরা হয় সুবিধা ভোগী কিংবা শাস্তি থেকে নিষ্কৃতির আশায় কাজ করে। পক্ষান্তরে সৈয়দ আবুল হোসেন কখনও নিজের স্বার্থের কথা ভাবেননি। তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারেন। দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর করতে যারা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন, সৈয়দ আবুল হোসেন তাদের মধ্যে একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। তিনি মৃত্যুর পরেও সকলের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তিনি জীবিতদের মধ্যে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন।
 
১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে অঁদ্রে মালরো এ দেশে আসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মালরোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ওই সময়ে অপমান, দুর্দশা ও মৃত্যু ছিল যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সে সময় তাঁর অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার আহ্বান তাঁদের জন্য কী অর্থ বহন করেছিল। ঢাকার বাইরে মালরো যান রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কাপ্তাইয়ে। তিনি শ্রদ্ধা জানান নির্মীয়মাণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে, দেখা করেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি। তিন দিনের সফর শেষ করে ২৫ এপ্রিল দুপুরে মালরো প্যারিসের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক অঁদ্রে মালরো ঢাকায় এসেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দেখার জন্য। ঢাকায় এসে তিনি একটি মন্তব্যও করেছিলেন। তখন সেই মন্তব্যের তাৎপর্যটি আমরা অনেকেই অনুধাবন করতে পারিনি। মালরো বলেছিলেন- ‘আপনাদের দেশটাকে পাকিস্তানের হানাদাররা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গেছে। এই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আপনারা শিগগিরই নতুন দেশ গড়ে তুলতে পারবেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা তাদের ২৪ বছরের শাসনে আপনাদের রাজনৈতিক কালচারে যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিষ ঢুকিয়ে গেছে তার দ্রুত উচ্ছেদ ঘটাতে না পারলে আপনাদের স্বাধীনতার চেহারা পাল্টে যাবে। আপনাদের সমাজজীবন ও মানসিকতায় বিনা যুদ্ধে শত্রুরা অনুপ্রবেশ করবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা আবার দখল করতে চাইবে।’ মালরো নিজের দেশ থেকে এর উদাহরণ টেনেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ফরাসি বিপ্লবের মূল কথা ছিল সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের আদর্শ শুধু ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠা করা নয়, সারা বিশ্বে তা প্রতিষ্ঠা করা। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রেসিডেন্ট লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের মূল কথাটি ছিল রুশো ভলতেয়ারের দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু তাতে কী হলো? ফরাসিরা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করেছে। কিন্তু রাজাদের সাম্রাজ্য-ক্ষুধা ও শোষণ-শাসনের মনোবৃত্তি মন থেকে তাড়াতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হিটলারকে পরাজিত করার পরও তারা ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য ও নীতির কাছে পরাজিত হয়েছিল। ফরাসি প্রজাতন্ত্র হয়ে উঠেছিল ব্রিটেনের পর দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ফ্রান্সে সবাইকে চমকে দিয়ে নাৎসিবাদী, হিটলারপন্থী দল গড়ে উঠছে। আমরা রুশো ভলতেয়ারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারের আলমারিতে সম্মানের সঙ্গে তুলে রেখেছি, প্যারিসে তাঁদের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করেছি। ফরাসি জাতিকে তাদের বাণী দ্বারা শিক্ষিত ও অনুপ্রাণিত করে তুলতে পারিনি। এই ভুলটি তোমরা কোরো না। টেগোর থেকে আরম্ভ করে বহু মনীষী তোমাদের দেশে জন্মেছেন। শেখ মুজিবের মতো নেতা তোমরা পেয়েছ। এখন জাতির মন ও মানসিকতা তাদের অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দ্বারা দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে। নইলে এই বিজয়, এই আত্মদান ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
 
আমাদের রাজনৈতিক কালচারের জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশ শাসকরা আমাদের যতই ক্ষতি করুক, একটি সুস্থ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কালচার উপহার দিয়ে গিয়েছিল। গান্ধী এই কালচারকে হিন্দু আশ্রমিক রাজনৈতিক কালচারে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম জীবনে লিংকনস ইনের ছাত্র এবং ব্যারিস্টার হিসেবে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কালচারের অনুসারী। তিনি খেলাফত আন্দোলনের পর্যন্ত বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নেহরুর সঙ্গে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে তিনি মধ্য বয়সে পৌঁছে রাজনৈতিক কালচারে ধর্মকে যোগ করেন এবং দেশটাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেন। কিন্তু তাঁর এই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ বেশিদিন টেকেনি। মাত্র ২৪ বছরের মাথায় ধর্মের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান ভেঙে যায় এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি দেশই স্বাধীনতা লাভ করে বিদেশি শাসকদের সঙ্গে আপসের দ্বারা। একমাত্র বাংলাদেশই স্বাধীনতা অর্জন করে সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা।

আরও পড়ুন