করোনার পরোক্ষ প্রভাবে শিশু-কিশোরদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিস

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৬-৬-২০২২ দুপুর ১০:৩৬

5Views

দেশে দীর্ঘ সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারকম প্রভাব ফেলেছে শিশু-কিশোরদের জীবনে। একদিকে মোবাইল ও ডিভাইসের প্রতি আসক্তি যেমন বেড়েছে, ঠিক একইভাবে তার প্রভাবে বেড়েছে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যাও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাজধানীর অনেক স্থানেই মাঠের অভাবে শিশু-কিশোরদের বিশাল একটা অংশ ঘরে মোবাইল ও ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমেই সময় কাটাচ্ছে। ফলে অপর্যাপ্ত ব্যয়াম ও শরীরচর্চার অভাবে শিশু-কিশোররা দ্রুতই মুটিয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে শিশু-কিশোরদের মাঝে অনেকেই স্থূলতায় ভুগছে, যাদের মাঝে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মাঝেও নানা কারণে বাড়ছে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১৮ হাজার শিশু-কিশোর ডায়াবেটিসে ভুগছে। এর মাঝে ৮২ শতাংশ টাইপ-১ এবং ১৮ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বিশেষ করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি পর বেড়েছে এই সংখ্যা। শুধুমাত্র রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে আট হাজারের বেশি শিশুর ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি বছরই গড়ে চার শ থেকে পাঁচ শ করে রোগী বাড়ছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই প্রকৃত চিত্র নয়। যেহেতু আমাদের দেশে এখনো ডায়াবেটিস রোগ শনাক্তে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং পর্যাপ্ত হয় না তাই সংখ্যা দিয়ে আসলে পরিস্থিতি বোঝানো যাবে না। এ কারণে অনেকেই আসলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে না। রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানেই এখন শিশু-কিশোররা মাঠের অভাবে খেলাধূলায় সম্পৃক্ত হতে পারে না। শারীরিক পরিশ্রমের কোনো সুযোগ থাকে না তাদের। আর তাই কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় ঘরে থেকে মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহারের যে অভ্যাস হয়েছে তা থেকে এখনো বের হতে পারেনি শিশু-কিশোরদের অনেকেই। এক্ষেত্রে তাদের ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্রিনিংয়ের আওতায় সময় মতো আসতে না পারার কারণে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে চোখ, কিডনি, রক্তচাপ, স্নায়ুজনিত জটিলতায় ভুগতে হয় শিশু-কিশোরদের। এক বছর বা এর চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় দেরিতে ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিশু মারা যাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ মহামারি নিয়ন্ত্রণে দেওয়া সাধারণ ছুটির সময়ে বাসায় যে সব শিশু-কিশোরদের শুয়ে-বসে, টিভি দেখে, মোবাইল বা কম্পিউটার গেমস খেলে সময় কাটানোর অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের মাঠে খেলাধুলার দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। এমন অবস্থায় অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি বাবা-মা দুইজনের কারও মাঝে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে সন্তানকেও স্ক্রিনিংয়ে আওতায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে সময় মতো লক্ষণ দেখা মাত্র সবাইকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

শিশু-কিশোরদের কত ধরনের ডায়াবেটিস হয়

১. নবজাতক বা নিওনেটাল ডায়াবেটিস: এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে হয়, যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে হয়। এই ডায়াবেটিস কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক হতে পারে, যা বড় হলে ভালো হয়ে যেতে পারে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা স্থায়ী রূপ নেয়।

২. বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিস বা মডি: এটা নবজাতক বা নিওনেটাল ডায়াবেটিসের মতো একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন বা ত্রুটির কারণে হয়। এটা বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে হয়। এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণত পরিবারের তিন জেনারেশনে এ ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকে। নবজাতক ডায়াবেটিস ও বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিসকে একত্রে মনোজেনিক ডায়াবেটিস বলে।

৩. টাইপ-১ বা জুভেনাইল ডায়াবেটিস: শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয় এ ধরনের ডায়াবেটিস। তবে বড়দেরও হতে পারে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন তৈরি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অথবা পুরোপুরি ব্যাহত হওয়ার কারণে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

৪. টাইপ-২ ডায়াবেটিস: শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তা রেসিস্ট্যান্সের জন্য কোষে কাজ করতে না পারার কারণে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত বড়দের বেশি হয় এবং বিশ্বব্যাপী এ ডায়াবেটিসের হার সবচেয়ে বেশি। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এর বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। শিশুদের ডায়াবেটিস হলে বড়দের তুলনায় জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ কী

এ রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা, অতিরিক্ত পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে সমস্যা, ওজন হ্রাস পাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী ঘা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি, শুষ্ক ত্বক, পা অবশ বোধ হওয়া বা ঝিমঝিম করা, মনোযোগ কমে যাওয়া, উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন বমি, পেটের পীড়া ইত্যাদি। অনেক সময় বাচ্চাদের ডায়াবেটিসে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না কিংবা মা-বাবা ব্যাপারটি খেয়াল করেন না। তাই বাচ্চাদের একটি বড় অংশ প্রথম অবস্থাতেই খিঁচুনি, পেটব্যথা, পানিশূন্যতা ও অজ্ঞান হয়ে অর্থাৎ কিটো এসিডোসিস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। উল্লিখিত যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।


আরও পড়ুন