বই আলোচনা

অনুভবের আসমান: বিদগ্ধ হৃদয়ের রক্তক্ষরণ

news paper

লিপি আক্তার

প্রকাশিত: ১৮-৬-২০২২ বিকাল ৫:৩২

21Views

চলমান জীবনের দুঃখ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল করে তোলে। আমরা আমাদের ইচ্ছেকে যখন বাস্তবে রুপ দিতে পারি না তখনই সংঘর্ষ ঘটে কল্পনা এবং বাস্তবের। বাস্তব জীবনে আমরা যা চাই তা বেশিরভাগ সময়ই পায়না। আমরা দেখার দৃষ্টিতে একে অপরের খুব কাছে কিন্তু মনোগত দিক থেকে আমাদের দূরত্ব যোজন যোজন দূরে।
এ প্রজন্মের তরুণ কবি আখতারুজ্জামান বাবলু’র ‘অনুভবের আসমান’ কাব্যগ্রন্থটি ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির বহির্প্রকাশ। এটি একটি অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। বইটি নিঃসন্দেহে লেখকও পাঠকদের মাঝে অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করেছে ও তাদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। ২০২২ সালের বইমেলায় কবি বইটি আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। অসাধারণ লেখনি ও শব্দচয়ণ কবিকে অনেক উচ্চে স্থান দিয়েছেন। তিনি যেন গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে একটি একটি করে মুক্তো দানা সংগ্রহ করে এনেছেন। হৃদয়কে স্পর্শ করে যায় তরি লেখনি। জীবন সম্বন্ধে হতাশা ও আশা দুটোই তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষের অন্তরে-বাইরে সর্বক্ষণ যে দ্বন্দ্ব- সংঘাত তা নিগূঢ়ভাবে কবির প্রত্যেকটি কবিতায় ফুটে ওঠেছে। যার কারণে নানাভাবে বইটি লেখককে পাঠকের খুব কাছাকাছি নিয়ে গেছে। এ কাব্যগ্রন্থটি কবির অনবদ্য সৃষ্টি।  

প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা একজন মানুষ ধীরে ধীরে কবিতা ভালোবেসে হয়ে উঠলেন কবি। তার কবিতায় জীবনের বাস্তবতাবোধ, প্রেম- বিরহ অথবা নৈসর্গিক প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান। তিনি বিষণ্ন হয়েছেন বার বার। আশার ভেলায় তার প্রেয়সিকে নিয়ে ভাসতে চেয়েছেন। ‘পথ’ কবিতায় কবি লেখেন: ‘চলো আমি আর তুমি/ চিকন আলোর পথ ধরে/অপ্রার্থিব প্রেম অভিসারে/ লীন হই অন্তহীন পথের বাঁকে- বাঁকে’। মেঘ ভেঙে বৃষ্টি ঝরে, কষ্টে নীল হয় কবি। তিনি সর্বদিকে কেবলই বেদনার চিত্র দেখতে পান। ‘দীর্ঘশ্বাস’ কবিতায় কবি লেখেন- ‘ভালোবাসার শূন্যতায় এখন কষ্টের নীল রঙ/সেই নীলে কেবলই বেদনার মুখোশ দেখি’। কবি আখতারুজ্জামান বাবলু’র কবিতায় আমরা তার হৃদয়ের হাহাকার শুনতে পাই। কবির ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের চিত্র কবিতায় চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘জ্যোৎস্নাময়ী সন্ধ্যাদীপ’ কবিতায় কবি লেখেন- “অনুভূতির রং এ এখন প্রার্থিব শূন্যতার হাহাকার”। ‘আশ্বিনের কোনো এক সন্ধ্যা’ কবিতায় কবি লেখেন-‘একটি সন্ধ্যা, তার কিছু টুকরো অংশ/কেমন সারল্য ছায়ায় অপরুপ/মায়াময় মুগ্ধতার স্রোতে স্রোতে/ অবশ বাসনার বর্ণিল খেলাঘর একাকার।’ পাওয়ার আকাক্সক্ষা এবং তার বেদনা কবিকে সর্বদা বেদনায় বিদগ্ধ করেছে এবং ঘটেছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। ‘যাতনার দহন পাঠ’ কবিতায় কবি লেখেন-‘বলা হলো না স্বপ্নময় রুপালি জ্যোৎস্নার স্বপ্নময় পৃথিবীর স¦প্নকথা’। এ বেদনার রুপ কাউকে দেখানো যায়না, কবিও দেখাতে পারেননি তার পাঠককে। ‘নক্ষত্রের ভাঁজে ভাঁজে’ কবিতায় কবি তাই লেখেন- ‘অনুভবে প্রাপ্তির স্বপ্ন ছেঁড়া শপথের মরা কান্না/ আর চলছে হাহাকার আকাক্সক্ষার/ সেখানে নিদারুণ মৌনতায়, কি বিদঘুটে অন্ধকার-----। কবির এই অসাধারণ শব্দচয়নের আলোকচ্ছ্বটায় আমরা উজ্জ্বল রঙিন প্রজাপতির মতো আরও রঙিন হই। 


কবি সারাজীবন ধরে মালা গেঁথেছেন শব্দ দিয়ে কিন্ত সে মালা তিনি গলায় পড়তে পারেন নি। কবি কৃত্রিমতাকে আশ্রয় দেননি। তিনি মানুষের অন্তর এবং বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনাকেই তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। ‘অনুভবের আসমান’ কবিতায় কবি লেখেন-“কষ্টের রেখায় লীন সন্ধ্যার মৌনতা---/‘মিহি পথ/তার ওপারে ভালোবাসা বোনা শ্যামল প্রান্তর/ছড়িয়ে ছিটিয়ে থোকা থোকা ভালোবাসা---/থমকে যায় আয়োজনের মুগ্ধতা/ আমি খুঁজিনি তারপর’। কবি প্রত্যেকের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিই সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। যেন কবিতা নই কবি আমাদের জীবনের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করছেন। ‘ঠিকানা’ কবিতায় কবি লেখেন-‘বিধ্বস্ত অন্তরগুলো খুঁজে ফিরে কি পথ/যে পথ আলোর/যে পথ অবারিত মুক্তির’। বিষাদে তার অন্তর ছুঁয়েছে তাই নির্মমভাবে মৃত্যু হয়েছে ইচ্ছের। ‘জিজ্ঞাসা’ কবিতায় কবি লেখেন- ইচ্ছেরা তে কবেই মরে গেছে----/ইচ্ছেরা কি এমনি এমনি মরে যায়/মেরে ফেলা হয় বাসনার নেতিবাচক নির্মমতায়’ ---------। কবিকে মাঝে মাঝে বড় অসহায় হতে দেখা গেছে। প্রখর দৃষ্টিভঙ্গিতে কবি অন্ধকারে ছবি এঁকেছেন। ‘আমি’ কবিতায় কবি লেখেন-‘আমি আমার চোখের অন্ধকার কাননে/ ছবি আঁকি চরম বিশ্বস্ততায়’। কবির বেদনাক্লিষ্ট হৃদয়ের বিলাপ শোনা যায়। সে বিলাপ ছড়িয়ে পড়ে দূর- দূরান্তে। প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটা অন্তরে। ‘নগ্নতার আশ্রয়ে মানুষের অরণ্য’ কবিতায় কবি লেখেন-‘অসংখ্য মানুষের শব্দহীন বিলাপ/যাতনার নীল বলয়ে বন্দি সমাজের শ্বাশত কানন/যেন নন্দিত কারাগার উপাখ্যান’। কবি ফিরতে পারে না স্মৃতি থেকে, স্মৃতির আকণ্ঠ বিষ পান করে নীল হয়। ‘স্মৃতির দহন পাঠ’ কবিতায় কবি লেখেন- ‘ফেরা হয় একসময়/স্মৃতির ফ্রেমে কষ্টগুলোকে বাধি, সরল নিসঙ্গতায়।’ এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষই নিজের ভিতর সর্বদা একটা ‘জিজ্ঞাসা’ নিয়ে পথ চলেন, বোধ করেন একাকী সর্বদা ‘আশ্রিত স্বপ্ন উপাখ্যান’ কবিতায় কবি লেখেন- তাহলে এই আমি কোথায়?/চোখ খুলে দেখি এই তো আছি মিথ্যা অরণ্যের নিকোষ/কালো ঘোর তমসায়। কবি নিজের গভীরে নিজে বার বার আশায় বুক বাধতে চেয়েছেন। ‘আপনজন’ কবিতায় কবি লেখেন-‘আমি আশায় বুক বাধি/গাঢ় অন্ধকারের ওপারে/বর্ণিল আলোর সমুদ্রে, পরম আপন জনের দেখা পাব বলে।’

জীবনের কোনে পূর্ণতা নেই কবি এটা বুঝেছিলেন। তিনি তাই বার বার খেলাঘর রচনা করেছেন, তিনি ভেবেছেন এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে তার প্রেয়সি। 
তাই কবি সমগ্র বিশ্বের মাঝে তার প্রতিচ্ছবি দেখেছেন। ‘মন’ কবিতায় কবি লেখেন-‘মানুষের মন অদৃশ্য রতন/সূক্ষè খেলাঘর/ মনের মাঝেই লুকিয়ে আছে/ পরম এক অধর’। কবি সর্বদা পুড়েছেন স্মৃতির আগুনে। ‘ফেরা’ কবিতায় কবি লেখেন- ‘অতঃপর/ফেরা স্মৃতির জানালায়/দহন পর/ পড়ে থাকা বিস্মৃতিগুলো’। কবি সর্বদা খুঁজে পেতে চেয়েছেন তার মনের মানুষকে নিভৃতে নির্জনে। কবি বলতে পারেননি তার হৃদয়ের আকুতি। তাই কবি তার প্রেয়সীকে পূর্ণ করে পেতে চেয়েছেন, ছুঁতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি। সেই আক্ষেপ তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে। ‘অভিমান’ কবিতায় কবি লেখেন-‘অভিমানে ছুঁইনি তোকে/অগোচরে ছিলি কিছু পথ/দুপুরের ক্লান্ত রৌদ্রের উত্তাপে/গলিত ভালবাসার ক্ষরণ’। মুক্তো দানা সে দানা থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়ায়। তার লেখা পড়তে গেলে ডুবে যেতে হয় সমুদ্রের; গভীরে ঘিরে ধরে অন্যরকম এক অজানা ভাবনা। প্রেমহীন জীবন, নিঃসঙ্গ সময়, একাকী কল্পকথা তার কাব্য প্রতিভাকে অনন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ‘ভালোবাসা বিলাপ’ কবিতায় কবি লেখেন-‘আমার মনে রিক্ততার নদীতে নীল লোনাজল/সেই লোনাজলে আশার ছায়ায় বাসর বন্দনা---/নীল জলে ভাটা পড়ে/বেদনার বিস্তর আবরণে ঢাকা পড়ে/মুগ্ধতার সকল আয়োজন’। তার কবিতা পড়লে তাঁর বেদনাবিদগ্ধ জীবনের করুণ সুর আমরা শুনতে পায় যা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় বার বার। ‘অদেখা এক স্বপ্ন ভিটে’ কবিতায় কবি লেখেন- ‘এক সময় অন্ধকার নামে/ রাশি রাশি, গাঢ় থমথমে/গভীর নির্জনতায় একটি ডাহুক কুঁকিয়ে কাঁদে’। ‘স্মৃতিপট’ কবিতায় কবি লেখেন-‘স্মৃতিগুলো এখন ঘিরে রাখে মায়াবী শকুন/নীলাভ অসংখ্য প্রজাপতিরা এক বর্ণিল খাঁচায়/ডানা বাধা রঙিন শিকলে’। রাতের অন্ধকারে পার করে কবি দেখেছেন কুয়াশাভেজা ভোর, স্বপ্নময়ীর উচ্ছ্বল দুটি চোখ ‘স্বপ্নবাসর’ কবিতায় কবি লেখেন-‘সেই কবে/কোনে এক কুয়াশাভেজা ভোরে/কুয়াশার পরিশ্রান্ত ভাঁজে দুটি চোখ দেখেছিলাম/তখন অনুভূতির কি নির্মল উচ্ছ্বাস/নানা রঙ্গের স্বপ্নবাসর’। কবির হৃদয়ের অব্যক্ত কান্না আমাদের চোখেও এনেছে অশ্রু। আর সে অশ্রুতে আমরা নিভৃতে ভিজে গেছি।
 
কবির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা তিনি আমাদের এত সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছেন। মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকতায়কেই বেছে নেননি বরং তিনি লাখো পাঠকের হৃদয়ের খোরাক ও যুগিয়েছেন। এজন্য ধন্যবাদ কবি আখতারুজ্জামান বাবলুকে যে তিনি আমাদেরকে এত সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছেন। ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক চেঙ্গিস খান। অমরত্ব পাওয়ার আশায় পাশবিক এ শাসক শেষ জীবনে পাগল হয়েছিলেন। অবশেষে তিনি চৈনিক ঋষি, মহাস্থবির কবি চাং চুংকে তার দরবারে এনে অনেক লোভ দেখিয়ে জানতে চান অমরত্ব পাওয়ার উপায়। আগের দিনের রাজা-বাদশাগণ অসহায়ত্বের সময় শেষপর্যন্ত কবির কাছেই ফিরে যেতেন। এখন ও আমরা দুদণ্ড শান্তির জন্য কবির কাছেই ফিরে যায়। কবিতা প্রসঙ্গে কবি এলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, ‘কবিতা সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সূক্ষ আত্মা।’ 

 


আরও পড়ুন