পাহাড়ে রক্তপাত অস্ত্রের ঝনঝনানি

কাজে আসছে না আধুনিক প্রযুক্তি

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৪-৬-২০২২ বিকাল ৫:৫৩

8Views

পার্বত্য অঞ্চলে বেড়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বেড়েছে টার্গেট কিলিং। চলছে আধিপত্যের লড়াই। হামলা-পাল্টা হামলায় সবুজ পাহাড়ে এখন রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। গত এক বছরে তিন পার্বত্য জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২০ জন। অপরাধ দমনে সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে আসছে না। 

পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ জেএসএস-মগ বাহিনীসহ বিভিন্ন গ্রুপের অস্তিত্ব দেখা যেত। নতুন গ্রুপ ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ‘কেএনএফ’ আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সংগঠনের ফেইসবুকে ৩ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র সংগঠন জেএলএ-এর সদস্য বলেও দাবি করা হয়।  

সূত্র জানায়, পার্বত্যাঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এসব সংগঠন সশস্ত্র সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে সেখানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য প্রতিটি সংগঠনই গড়ে তুলেছে অস্ত্র ও অর্থের ভান্ডার। আর অস্ত্র ও অর্থের জোগান কোথায় থেকে এবং কারা দেন, তা আড়ালেই থাকছে। পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সবাই তাদের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান, পাহাড়ের বাসিন্দাদের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি বলেও বাসিন্দারা দাবি করছেন। পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের নেতৃত্বে পাহাড়িরা ঐক্যবদ্ধ।

এদিকে রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুর্গম বড়থলি এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবা-ছেলেসজ তিন গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বড়থলির সাইজান নতুন পাড়ায় এই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটেছে। বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ইউনিয়ন সভাপতি আতুমং মারমা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উক্ত এলাকাটি অত্যান্ত দুর্গম হওয়ার কারণে পুলিশসহ আইন-শঙ্খলা বাহিনীর প্রথমে বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি। 

অপরদিকে ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ’ নামের একটি সংগঠনের ফেইসবুকে তিনজনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। নিহতরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র সংগঠন জেএলএ-এর সদস্য বলে দাবি করা হয়েছে।  গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পার্বত্য অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। কোন কোন এলাকায় তিন থেকে ৭দিন পর্যন্ত সময় লাগে। আর অপরাধীরা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে দ্রুত চলে যেতে পারে। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির কাজে আসে না। ফলে অপরাধ দমন করা খুবই দুরূহ বিষয়। তারপরও দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরতম পরিশ্রম ও দেশ রক্ষার তাগিদে কাজ করে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসীদের হামলা ও গুলিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিহত হচ্ছেন।

স্থানীয় জেএসএস নেতা আতুমং মারমা সকালের সময়কে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ‘কুকিচীন পার্টি’ নামের একটি নতুন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মীরা বড়থলি ইউনিয়নের সাইজান নতুন পাড়ায় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই তিন জন নিহত হন। তার ভাষ্য, হামলায় বৃষচন্দ্র ত্রিপুরা, সুভাষ ত্রিপুরা ও সুভাষের ছেলে ধনরা ত্রিপুরা নিহত হয়েছেন। নিহতর সবাই নিরীহ গ্রামবাসী বলে জানানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১২ঘণ্টার হাঁটা দূরত্বে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অবস্থান করে এ খবর জানিয়েছেন আতুমং মারমা। তবে হত্যাকাণ্ডের কারণ কেউ বলতে পারেনি। ওই পাহাড়ে নতুন গড়ে ওঠা সাইজান নতুন পাড়ায় মাত্র তিনটি পরিবার বসবাস করে। এলাকাটি খুবই দুর্গম। সেখানে কোন প্রকার প্রযুক্তির ছোঁয়া পর্যন্ত পৌঁছেনি। আতোমং মার্মা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সকালের সময়কে জানান, ঘটনাস্থল অত্যান্ত দুর্গম এলাকায় এখনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কেউ যায়নি। আর ঘটনাস্থলে গুলিতে তিনজন মারা গেছেন, তা স্থানীয়রা দেখেছেন। শুক্রবার থানা পুলিশ সেখানে যাবে বলে আমি শুনেছি। থানায় কোন মামলা হয়েছে কি না তা- আমি জানি না। 

বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বড়থলির চেয়ারম্যান তাকে জানান। পরে আমি বিলাইছড়ি থানাকে জানিয়েছি। এলাকাটি এতই দুর্গম যে সেখানে বিলাইছড়ি থেকে তিন দিন, পাশ্ববর্তী রুমা উপজেলা থেকে যেতেও দুইদিন সময় লাগে। পুরো বিষয়টি রুমা জোনকে অবহিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিলাইছড়ি থানার ওসি আলমগীর হোসেনকে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ঘটনার পর রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মাহমুদা বেগম গণমাধ্যমে বলেন, বিষয়টি আমরাও শুনেছি। তবে দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে পৌঁছানো কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। তাই আমরা এখনও নিশ্চিত কিছু বলতে পারছি না। 

অপরদিকে ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ’ নামের একটি সংগঠন তাদের ফেইসবুক পেইজে এক বিজ্ঞপ্তিতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। সংগঠনটির ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পালনকারী নিজেকে ‘লে. কর্নেল সলোমন’ হিসেবে পরিচয় দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, কেএনএফ-এর স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স হেড-হান্টার টিম সন্ত্রাসী জেএসএস’র সশস্ত্র বাহিনী জেএলএ-এর জাইজাম বেসমেন্ট ক্যাম্পে সফলভাবে হামলা চালিয়েছে। এতে জেএলএ বাহিনীর তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তবে আহত অবস্থায় ট্রেইনিসহ অন্যরা সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বহুমুখী ও জটিল। রাজনৈতিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান হতে হবে। নতুবা রক্তাক্ত পাহাড়ের কান্না থামানো অসম্ভব। গত ফেব্রুয়ারিতে রুমায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর টহল কমান্ডার সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান। আর এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন সৈনিক ফিরোজ। এ সময় সেনাবাহিনীর পাল্টা গুলিতে মারা যান তিন সন্ত্রাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড় ২০২১সালের পুরোটাই উত্তপ্ত ছিল। গত বছরের ১৯ জানুয়ারি বিলাইছড়িতে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সাতজনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। ১১ ফেব্রুয়ারি লামায় ছাত্রী অপহরণের ঘটনা ঘটে। ১৮ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়িতে গভীর রাতে গোলাগুলি হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাঘাইছড়ি রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সমর বিকাশ চাকমাকে গুলিতে নিহত হন। ২ মার্চ দিঘিনালায় যৌথবাহিনীর অভিযানে অস্ত্র, গুলি, ম্যাগজিন, নগদ অর্থসহ চার সন্ত্রাসীকে আটক হয়। ৪ মার্চ রাঙ্গামাটির লংগদু নদীতে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার। ১এপ্রিল বাঘাইছড়িতে সহকর্মীর গুলিতে বিশ্ব চাকমা নিহত হন। ২৯ এপ্রিল বান্দরবানে সেনা অভিযানে ভারী মারণাস্ত্রের গুলি, বিপুল গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ১৫ জুন জুরাছড়ির লুলাংছড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ‘কার্বারি’ নিহত হন। ২০ জুন রোয়াংছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এক যুবক নিহত হন। ২৭ জুন খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় ইউপিডিএফের কর্মী খুন হয়। ২৮ জুন নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়। ১০ জুলাই রাইখালীতে সন্ত্রাসীদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একজন। খাগড়াছড়ির গুইমারাতে সেনাবাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ চারজন ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী আটক হন। ১৮ জুলাই পানছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খল কুমার ত্রিপুরা নিহত হন।

১৯ জুলাই বান্দরবানে পল্লী চিকিৎসক অপহৃত হন। ২৫ জুলাই রাঙ্গামাটি মগবান এলাকায় বাসিরাম তংচঙ্গ্যাকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। ১ আগস্ট রাঙ্গামাটি সেনাবাহিনীর অভিযানে এ কে ২২ রাইফেল, ৭৭ রাউন্ড গুলি ও ১টি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া ২৭ ডিসেম্বর পানছড়ির সাতছড়ি থেকে ১৫টি মর্টার শেল, ২৫টি বুস্টার ও ৫১০ রাউন্ড অটো মেশিনগানের গুলিসহ বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ির ২ কিলো নামক স্থানে আঞ্চলিক দুই গ্রুপের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন দু’জন। পরে অভিযান চালিয়ে একে ৪৭ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি দিঘিনালায় সেনাবাহিনীর অভিযানে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়। গত ১০ জুন আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে বান্দরবানের রাজবিলায় পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও মগ লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) মধ্যে গোলাগুলিতে ৩ জন আহত হন। আর দু’কর্মীকে অপহরণ করে মগ বাহিনী।

 


আরও পড়ুন