লাম্পি স্কিন নিয়ে খামারিদের দুশ্চিন্তা

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৪-৯-২০২২ দুপুর ১১:৩৭

14Views

দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে গরুদের ভাইরাসজনিত রোগ লাম্পি স্কিন ডিজিস (এলএসডি)। পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় আতঙ্ক বাড়ছে খামারিদের মধ্যে। মেহেরপুরে ও পাবনায় বহু গরুর মধ্যে লাম্প স্কিন ডিজিজ ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেরপুরে বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৫০ ভাগ গবাদিপশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। জেলা  প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় প্রায় ৩০ হাজার গরু এ রোগে  আক্রান্ত হয়েছে।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, এলএসডি একধরনের ভাইরাসজনিত রোগ। এটি গরুর একধরনের চর্মরোগ। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ যেমন মশা ও বিশেষ প্রজাতির মাছি ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এ ধরনের কীটপতঙ্গ আক্রান্ত গরুকে দংশন করার পর অন্য একটি সুস্থ গরুকে দংশন করলে সেই গরুটিও আক্রান্ত হয়। আবার আক্রান্ত গরুর লালা খাবারে মিশে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়চোপড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।

আক্রান্ত গাভির দুধেও এই ভাইরাস বিদ্যমান। তাই আক্রান্ত গাভির দুধ খেয়ে বাছুর আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গরুর সিমেনও (বীর্য) এই রোগের অন্যতম বাহন। প্রাণিচিকিৎসকেরা বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণ হলো জ্বর। এরপর ত্বকের ওপরে বড় মাপের ফোড়া বা গোটা তৈরি হয়। মানুষের জলবসন্ত হলে যেমন হয়, এটি অনেকটা তার কাছাকাছি। শরীরজুড়েই গোটা তৈরি হতে থাকে। কয়েক দিনের মাথায় সেগুলো ফেটে তরল নিঃসৃত হতে থাকে। এর কিছুদিন পরে ওই গোটা বা ঘা ধীরে ধীরে শুকায়।

এলএসডি সব গরুর ক্ষেত্রে এক রকম নয়। কোনো কোনো গরু বিশেষ করে যেসব গরু প্রথমবার আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ মারাত্মক আকার নিতে পারে। এমন ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বেশি। আক্রান্ত গরুর শরীরে ফোসকা পড়ে যায়। কোনো গরুর পা, অণ্ডকোষ ফুলে যায়, কোনো গরুর গলায় ঘা হয়। কিছু কিছু আক্রান্ত গরুর চামড়ার নিচে পচন ধরে।

সঠিক চিকিৎসা না হলে গরু দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় গরুর মৃত্যুসহ নানা মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক গরুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে, এতে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। গর্ভবতী প্রাণীদের গর্ভপাত হতে পারে। রোগের তীব্রতা কম হলে যথাযথ চিকিৎসায় এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে এবং তীব্রতা বেশি হলে এক থেকে দেড় মাসে আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়ে ওঠে।

গ্রামের বেশির ভাগ কৃষক ও খামারি না বুঝেই হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে গরুর চিকিৎসা করছেন। এর ফলে রোগ সেরে যাওয়ার পরও অনেক গরু নানা জটিলতায় ভোগে। রোগটির চিকিৎসা প্রটোকল নিয়ে মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকদের মধ্যে সংশয় আছে।

পাবনা: পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় এই রোগে ১৫০টি গরু আক্রান্ত হয়েছে। তারমধ্যে মারা গেছে ছয়টি গরু। সাঁথিয়া উপজেলার গৌরী গ্রামের খামারি সেলিম রেজা বলেন, ‘গ্রামের অনেক গরু এ রোগে আক্রান্ত। আমি গরু নিয়ে খুবই চিন্তিত। পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়েই তারা গ্রামীণ ডাক্তারদের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন।’ 
সাঁথিয়া পৌরসভার কালাইরা গ্রামের হাসান আলী বলেন, ‘এ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্কে ছিলাম। এ কারণে কসাইয়ের কাছে একটি গরু বিক্রি করেছি মাত্র ১৫ হাজার টাকা, যার মূল্য ছিল প্রায় ৯০ হাজার টাকা।’
একই গ্রামের কৃষক শের আলী বলেন, ‘আমার ৯টি গরুর মধ্যে ৪টি এ রোগে আক্রান্ত। গরুর চিকিৎসায় প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।’

চরমাছখালী গ্রামের অটোরিকশা চালক জিয়ারুল বলেন, ‘চার মাস আগে অনেক কষ্টে একটি গরু কিনেছিলাম কিন্তু আমার এক লাখ টাকা মূল্যের গরুটি নতুন এ রোগে মারা গেছে।’বাঘা বাড়ি মিল্কভিটার উপ-ব্যবস্থাপক চিকিৎসক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। দ্রুত বিস্তারের কারণে গরু ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও গরু মারা যাচ্ছে। এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় দুগ্ধ শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে।’ 
এ ব্যাপারে সাঁথিয়া উপজেলা উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ এলাকায় লাম্পি স্কিন ডিজিসে কিছু গরু আক্রান্ত হয়েছে। তবে বর্তমানে অনেকটা ভালো। অফিস থেকে খামারিদের পরামর্শ দেযা হচ্ছে। আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা করা হচ্ছে।’ এই ভাইরাসজনিত রোগের কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা নেই। তাই বিকল্প ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আগে রোগটির প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে। তাই এই রোগের ভ্যাকসিন সহজলভ্য নয়। এ রোগে কম গরু মারা যায়।’পাবনা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. স্বপন কুমার সরকার সকালের সময়কে বলেন,‘লাম্পি স্কিন ডিজিসটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি বহু বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশে দেখা গিয়েছিল। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এ রোগটি আমাদের দেশেও দেখা দিয়েছে। তবে এ রোগের কারণে গরুর মৃত্যু হার কম। এ রোগে আক্রান্ত গরু সুস্থ্য হতে একটু সময় বেশি লাগে। সদর উপজেলায় প্রায় ১৫০ গরু আক্রান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান। এ রোগ হলে জ্বরের ঔষধ ও ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার যেমন লেবু খাওয়ানোই যথেষ্ঠ।’ 

পাবনা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভ্যাটারিনারি সার্জন ডা. স্বপন কুমার সবরকার এই প্রতিনিধিকে বলেন,‘খামারে কাজ করা মানুষের পোশাকের মাধ্যমে আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই খামারের ভেতরের এবং আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যেন মশা মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আক্রান্ত গরুকে শেড থেকে আলাদা স্থানে মশারি দিয়ে ঢেকে রাখা মশা মাছি কামড়াতে না পারে। কারণ আক্রান্ত গরুকে কামড়ানো মশা মাছি ভালো গরুকে কামড়ালে এই রোগের সংক্রমণ হতে পারে। আক্রান্ত গভীর দুধ বাছুরকে খেতে না দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া ভালো।
আক্রান্ত গরুর পরিচর্যা শেষে একই পোশাকে সুষ্ঠু অর্থাৎ ভালো গরুর মধ্যে প্রবেশ না করা উচিৎ। আক্রান্ত গরুর খাবার বা ব্যবহার্য কোনো জিনিস ভালো গরুর কাছে না আনা এবং ক্ষতস্থান টিনচার আয়োডিন মিশ্রণ দিয়ে পরিষ্কার রাখা।

পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আল মামুন হোসেন মন্ডল বলেন,“ এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। জেলায়  বেশ কিছু গরু লাম্পি স্কিন ডিজিস অর্থাৎ চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত গরুর ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। যখনই কোন জায়গার খবর পাচ্ছি; থখনই প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে লোক পাঠিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।”এই রোগে আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন প্রকারেই গ্রাম্য বা হাতুড়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন প্রাণিসম্পদের এই কর্মকর্তা। 

মেহেরপুর: মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৫০ ভাগ গবাদিপশুর মধ্যে ছড়িয়ে  পড়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিস। জেলা  প্রাণিসম্পদ অধিদপ্ত সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় প্রায় ৩০ হাজার গরু এ রোগে  আক্রান্ত হয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও আব্দুর রহমান জানান, আমাদের এলাকার  প্রায় প্রতিটি বাড়িতে  এই লাম্পি স্কিন ডিজিসে  গরু আক্রান্ত হয়েছে। 

গাংনী উপজেলার বালিয়াঘাট গ্রামের সুলতান আলী জানান, লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে বুধবার সকালে আমার একটি বাছুর মারা গেছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এছাড়াও আরো দুটি গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।উপজেলার পলাশিপাড়া গ্রামের খামারি মজিরুল ইসলাম জানান, ‘আমার গরুর গায়ে গুটি দেখা দিলে আমি  ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করি। তিনি আক্রান্ত গরুটি  অন্য গরু থেকে আলাদা রাখার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন।

উপজেলার গোপালনগর গ্রামের কৃষক নাসির ও শামিম জানান, তাদের দুটি বাছুর এ রোগে আক্রান্ত। এনজিও থেকে ১ লক্ষ টাকা লোন নিয়ে বাছুর দুটি কিনেছিলেন তারা।  দুই মাসের মাথায় এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বাছুরগুলো।’এ ব্যাপারে গাংনী উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন ডা: মো. আরিফুল ইসলাম জানান, গাংনী উপজেলার পশু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০টি গরুর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গাংনী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে সরকারিভাবে গরুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তের কর্মকর্তা ডা: মো. সাইদুর রহমান জানান, জেলার প্রায় ৫০ ভাগ গরু এ রোগে আক্রান্ত। ভ্যাকসিনের যথেষ্ট অভাব আছে।  প্রাথমিকভাবে অ্যান্টিপাইরেটিক ও অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নডিউল বা গুটি ফেটে গেলে বা সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন দমন করার জন্য ক্ষতস্থানে পভিসেপ অথবা ভায়োডিন দিয়ে ড্রেসিং করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।


আরও পড়ুন