ইয়াবার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৬-৯-২০২২ দুপুর ১২:১০

9Views

*    এনক্রিপ্টেড অ্যাপস ব্যবহার
*    ছড়িয়ে পড়ছে সব পেশায়
*    কারবারে জড়িত চিকিৎসকও

মাদক কারবারিদের ধরতে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যত তৎপর হচ্ছে, তার চেয়ে দ্বিগুন কৌশলে ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ পেশার আড়ালে দেদারসে ইয়াবার ব্যবসা করছেন। 

ডাক্তার-কবিরাজ, মাছ-মাংস বিক্রেতা, কাপড়ের ব্যবসায়ী, রেডিও টিভির মেকানিক থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জেম পর্যন্ত এই মরণ নেশার ইয়াবা ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিকিউরিটি কোম্পানির আড়ালে ইয়াবা সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। 

জানা গেছে, ৯৬৮০ পিস ইয়াবা ও ৩ গ্রাম আইসসহ রাজধানীর উত্তরায় এক সিকিউটি কোম্পানির তিন নিরাপত্তা রক্ষীকে গ্রেফতার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। গ্রেফতারকৃরা হলেন, মো. ইসমাইল (৩২), রবিউল হাসান মামুন (২০) ও রবিউল হাসান মামুন (২০)। গ্রেফতারকৃতরা এলিট ফোর্স নামে একটি সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ড। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) এর উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান ও রমনা সার্কেলের পরিদর্শক তমিজ উদ্দিন মৃধার নেতৃত্বে শনিবার রাজধানীর উত্তরার ৭ নং সেক্টরের রবীন্দ্র স্মরণী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফাতরকৃতরা টেকনাফ, ঢাকার উত্তরা ও গাজীপুর কেন্দ্রীক একটি সক্রিয় মাদক চক্রের সদস্য বলে জানা গেছে। তারা টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান এনে ঢাকা ও গাজীপুরের মাদক ব্যবসায়ীদের পাইকারি দরে সরবরাহ করত। এলিট ফোর্সে গার্ডের চাকরির সুবাদে তাদের কেউ সন্দেহ করতো না বলে তারা জানিয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা গোপনীয়তার স্বার্থে নিজেদের মধ্যে এনক্রিপ্টেড অ্যাপস ব্যবহার করতো। তারা কোন নির্দিষ্ট ফোন নম্বর ব্যবহার না করে ক্রমাগত নম্বর পরিবর্তন করত। এনক্রিপ্টেড অ্যাপসসমূহ বিশ্লেষণ করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান জানিয়েছেন। 

অপর দিকে টিভি ও গাড়ির পার্টস ব্যবসার আড়ালে দেশে মাদকের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। আর এ ধরনের অভিযোগে গত জুলাই মাসে আহাদ (২২) ও আশিক (২৪) নামে আপন দুই ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।সুত্র জানায়, অবৈধ মাদক সিএন্ডএফের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনার পরে সেগুলো মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, রাজধানীর বংশাল এবং ওয়ারী এলাকায় ওয়্যার হাউসে রাখা হতো। পরে সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে মাদকের চালান ট্রাক ও কনটেইনারে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য পণ্যের আড়ালে কৌশলে সরবরাহ করা হতো। গত ২৪ জুলাই র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানিয়েছেন। 

তার আগের দিন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় চট্টগ্রাম হতে ঢাকাগামী মহাসড়কে চেক পোস্টে দুটি কনটেইনারে তল্লাশি চালিলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে আনা ৩৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৩৭ হাজার বোতল বিদেশি মদ ও কোটি টাকা মূল্যের দেশি ও বিদেশি মুদ্রাসহ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আব্দুল আহাদসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১। সেখান থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোট ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করে। আর জব্দকৃত মাদকের ৩১ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা ভ্যাটসহ সর্বমোট মূল্য ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

তাছাড়া অবৈধ চালান আমদানির সঙ্গে জড়িত ওয়ারীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ দেশি এবং বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। যার পরিমাণ নেপালী রুপি ১৫ হাজার ৯৩৫, ইন্ডিয়ান রুপি ২০ হাজার ১৪৫, চায়না ইওয়ান ১১ হাজার ৪৪৩, ইউরো ৪ হাজার ২৫৫, থাই বার্থ ৭ হাজার ৪৪০, সিংগাপুর ডলার ৯ এবং মালয়েশিয়ান রিংগিত ১৫। অভিযানে গ্রেফতার হয় মো. নাজমুল মোল্লা (২৩) ও মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল (৩৪)। এই চক্রের অন্যতম হোতা আব্দুল আহাদও গ্রেফতার হন। 

অপরদিকে রাজধানীর বেনারসি পল্লীতে কাপড়ে কারচুপি কাজের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসার তথ্য পাওয়া গেছে। মিরপুর বেনারশি পল্লীতে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রাজু নামের এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত রাজু পান সিগারেটসহ কোন বদ অভ্যাস নেই। অথচ এই ভদ্রতার আড়ালেই ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। তার বাসা থেকে জব্দ করা হয় ১ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা। এরপর এক লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয় করে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে পুনারায় একই পেশায় নিয়োজিত হন। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব মনিপুরিপাড়ার তার বাসায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবাসহ পুনরায় গ্রেফতার হন রাজু। চট্টগ্রাম থেকে জনৈক বিল্লালের কাছ থেকে তিনি ইয়াবা আনেন। পাইকারি এনে পাইকারি বিক্রি করেন। পিস প্রতি তার লাভ ১০ টাকা।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ঢালাইয়ের কারখানায় কাজের আড়াতে ইয়াবার ব্যবসা চালানো হতো। গত আগস্ট মাসে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা হানা দিয়ে কালাম নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে কালাম এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আবার রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে একাধিক কাপড় ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এছাড়া, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় এলাকায় ঢাকাগামী একটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ৭ হাজার ৮৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এক চিকিৎসক ও নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১১ এর সদস্যরা। গ্রেফতারকৃতরা হলেন ডা. আরিফ মঈনউদ্দিন (৩০) ও জুলি আক্তার ওরফে রুপা (২৮)। ডা. আরিফ মঈনউদ্দিন ডাক্তারি পেশার আড়ালে ইয়াবার ব্যবসা ও সরবরাহ করতেন বলে র‌্যাব জানিয়েছে। এ ঘটনার পর র‌্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরীর পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত আরিফ মঈন উদ্দিন পেশায় একজন এমবিবিএস চিকিৎসক। তিনি চট্টগ্রামের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ইউএসটিসি হতে ২২তম ব্যাচে এমবিবিএস পাস করেন। ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। এক পর্যায়ে নিজেই ইয়াবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ডাক্তারি পেশার আড়ালে কৌশলে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তার এই অবৈধ মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে একাধিক নারী ও পুরুষ সহযোগী হিসেবে জড়িত রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আরিফ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানিয়েছে, ডাক্তারি পেশার আড়ালে আর্থিকভাবে লাভবান হতেই তারা এই ইয়াবার ব্যবসা করছিল।


আরও পড়ুন