লঞ্চের নতুন রুট সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ!

news paper

এম. শাহজাহান

প্রকাশিত: ৬-১০-২০২২ দুপুর ১১:৪০

10Views

পদ্মা নদীর শিমুলিয়া ঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল করবে কিনা- সে ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এরপরই হবে সিদ্ধান্ত। তাই অপেক্ষা করতে হবে সম্ভাব্যতার প্রতিবেদন পর্যন্ত। ততদিন লঞ্চ নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই মালিকদের। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও লঞ্চ চালানোর সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়েই এখন বিকল্প ব্যবসায় ঝুঁকছে তারা। বিশেষ করে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই লঞ্চগুলো এখন ভাঙারিতে বিক্রির কথা বলছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি বিআইডব্লিউটিএর ৫ সদস্যের একটি দল ঘুরে আসেন মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট। প্রাথমিক প্রতিবেদনে তারা এ ঘাট ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। রিপোর্ট হাতে পেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ফের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কমিটি গঠন করে দেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ মেয়াদী হতে পারে এমনটা সম্ভাবনায় হতাশায় ভুগছেন অনেক লঞ্চ মালিক। 

এ দিকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট নিয়ে সরকারের ইকোপোর্টের ভাবনা একটি যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন পর্যটক বিশেষজ্ঞরা। পদ্ধাসেতু উদ্বোধনের আগেই এই ঘাট ঘিরে পর্যটনের যে নতুন দ্বার খুলেছে তা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ অনেকটা হতাশ করছে তাদের। যদিও বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর লঞ্চ চালচলে নতুন রুটের কথা বলে আসলেও মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে মোটেও কর্ণপাত করেননি। এতে একদিকে লঞ্চ মালিকরা পড়েছেন বিপাকে; অন্য দিকে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে। 

নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মাসেতু ঘিরে পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট এলাকায়। সিঙ্গাপুরের আদলে ইকোপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। পদ্মার নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার লক্ষ্যে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে সেখানে। যদিও শিমুলিয়া এলাকায় পদ্মার ইলিশ, পদ্মার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এবং পদ্মা সেতু নিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ বেড়েছে দিন দিন। এসব বিবেচনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এই সংস্থাটি সরকারের নীতিনির্ধারকদের সবুজ সংকেতে প্রাথমিক প্রস্তাবনা তৈরি করে। ৫ সদস্য বিশিষ্ট এই প্রস্তাবনা তৈরি কমিটির প্রধান বিআইডব্লিউটি এর অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) একেএম আরিফ উদ্দিন। কমিটির সদস্যরা পুরো এলাকা নিয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবে রয়েছে- নৌ বিনোদন কেন্দ্র এবং কনটেইনার টার্মিনাল। এর পরপরই শিমুলিয়া ঘাট ঘিরে নতুন ব্যবসার দিকে নজর পড়ে লঞ্চ মালিকদের। অর্থাৎ পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর যেসকল রুটে লঞ্চ ব্যবসায়ীরা যাত্রী সঙ্কটে ছিলেন তারা এই রুটের জন্য আবেদন শুরু করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ রুটে নতুন আবেদন গ্রহণ করেনি। লোকসানের ভার কমাতে অনেকে তাদের লঞ্চ ভাঙারিতে বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন। 

জানা গেছে, পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো সবই থাকবে এই ইকোপোর্টে। শিশুদের জন্য থাকবে আকর্ষণীয় রাইডস। বন্দরটিকে পরিকল্পিতভাবে সাজানো হবে গাছপালায়। গাছপালার মাঝেই থাকবে পর্যটকদের বসার নান্দনিক স্থান। আন্তর্জাতিক মানের এই নৌ বিনোদন কেন্দ্রে নৌবিহার ছাড়াও রিভার ট্যুরিজমের জন্য নানা রকম বোট, ভাসমান রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে অবকাশকালীন সময় কাটানোর সুযোগ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিমুলিয়া ঘাট লাগোয়া উজান প্রান্তে পদ্মাসেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড পর্যন্ত পদ্মাসেতু প্রকল্পের আওতায় নদীশাসন হচ্ছে। খড়িয়া থেকে একেবারে দিঘিরপাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে ৯ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় ৪৪৬ কোটি টাকায় নদীশাসনের কাজ চলমান রয়েছে। পদ্মার পাড়ে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় নদীশাসন করে এই ইকোপোর্ট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

এদিকে সড়কপথে খুব অল্প সময়ে সেতু পার হয়ে চলে যাওয়া যায় দক্ষিণের ২১ জেলায়। আবার দিনে দিনে রাজধানীতে এসে পৌঁছাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত নানান পণ্যও। আর এর প্রভাব পড়েছে দীর্ঘ কয়েক দশকের লঞ্চ ব্যবসায়। যাত্রী সংকট আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে যুগ যুগ ধরে চলা ঢাকা-বরিশাল রুটের জমজমাট লঞ্চ ব্যবসায় এখন শনির দশা। রোটেশন করে চালিয়েও লাভের মুখ দেখতে পারছেন না লঞ্চ মালিকরা, তাই বাধ্য হয়েই কোটি-কোটি টাকার লঞ্চ কেটে লোহার দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, রাজধানীর পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটে কামাল-১ নামের একটি লঞ্চ কাটার কাজ চলছে। তিনতলা এই লঞ্চটির বেশিরভাগ অংশই কাটা হয়ে গেছে। বাকি অংশও কাটা হচ্ছে গ্যাসের আগুন দিয়ে। বিশাল এই লঞ্চের লোহা ও স্টিল সিটগুলো বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে, জায়গা হবে ভাঙারির দোকানে। এর কিছুদিন আগে একইভাবে কেটে ফেলা হয়েছে রাজধানী নামের আরেকটি লঞ্চ। দূরেই কাটার জন্য অপেক্ষায় আছে প্রিন্স সাকিন-৪ নামের আরেকটি লঞ্চ।

এ বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক বলেন, আমার নিজের লঞ্চে তেলের ৪৭ হাজার টাকা বাকি পড়েছে। সবাই লোকসানে আছে। আগে যেখানে দিনে ৭-৮টা লঞ্চ যেতো, এখন রোটেশনে তিনটা করে চালানো হচ্ছে তারপরও টাকা উঠছে না। এ ছাড়া পদ্মাসেতু চালুর পরই বিশাল শিমুলিয়া ফেরিঘাটের প্রয়োজনীয়তা হঠাৎ কমে যায়। অধিকাংশ ফেরিই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে ঘাট এখনও রয়েছে। ৮৭ লঞ্চের মধ্যে ৫ থেকে ৭টি চলাচল করছে মাত্র। এরই মধ্যে ২৫টি লঞ্চ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তবে এখানকার ১১টি লঞ্চকে দোহারের মৈনট ঘাট-ফরিদপুরের চরভদ্রাসন নতুন লঞ্চ রুটে রুট পারমিট দেয়া হয়েছে। ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের এই রুট জনপ্রিয় হয়ে উঠলে আরও লঞ্চ পাঠানো হতে পারে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, আমাদের চার্টার ডিউটির বাইরে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আর বিশাল এই জমি খালি ফেলে রাখা ঠিক হবে না। এসব বিবেচনায়ই আন্তর্জাতিক মানের ইকোপোর্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে।
তিনি জানান, শিমুলিয়া ঘাটের পূর্ব পাশে একটি বিশাল চর রয়েছে। প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই চর ঘিরে বেসরকারিভাবে নৌ বিনোদন কেন্দ্র করার ব্যাপারেও প্রস্তাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ইকোপোর্টটি যত দ্রত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। এটি চালু হলে লঞ্চ মালিকরা যেমন উপকৃত হবেন তেমনেই সরকার পাবেন বিপুল অংকের রাজস্ব। 

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক এ বিষয়ে জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে। রাজধানী ঢাকার কাছের এই এলাকাটি নগরবাসীর কাছে তথা পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানে রূপান্তরে পরিকল্পনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই আধুনিকমানের করে ইকোপোর্ট করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। তিনি আরও বলেন, নদী হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। তাই নদী ও নদীতে বহনকারী লঞ্চের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। তাছাড়া নদী পথে যাতায়াতে মানুষের যেন কোনো কষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। 


আরও পড়ুন