শিক্ষাক্ষেত্রে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা

news paper

মো: মাসুদুল হাসান

প্রকাশিত: ১৫-১১-২০২২ দুপুর ৪:৪০

47Views

উন্নয়নের পূর্বশর্ত হল দক্ষ জনবল। আধুনিক বিশ্বে দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানুষের কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে মানুষের সৃজনশীলতা, মেধা, মনন, শিক্ষা ও দক্ষতা। বিশেষ করে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর উৎপাদন ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় নতুন গতি। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি, মানবসম্পদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও প্রেষণা। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক পরিমাণ কর্ম সম্পাদন  ও কাজে গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব। এই লক্ষ্য গুলো সামনে রেখে আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা আবর্তিত হচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাকে মানব সম্পদ উন্নয়নের ভিত্তি বলা যেতে পারে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। 

কর্মী ব্যবস্থপনা কর্মীদের সুপ্ত ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। কর্মী পরিতৃপ্তি চারটি বিষেয়ের উপর নির্ভর করে : ১। ক্ষমতা, ২। আনন্দ, ৩। সুযোগ, ৪। ব্যক্তিত্ব । 

কর্মী ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ধরনের দর্শন রয়েছে। 


১। উৎপাদনের উপকরন দর্শন :  এই দর্শন অনুযায়ী কর্মীদের শুধুমাত্র “উৎপাদনের উপকরন” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 
২। মানব সম্পর্ক মতবাদ : কর্মীদের “মানবিক বিষয়” এর উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। 
৩। মানব সম্পদ মতবাদ : কর্মীদের দক্ষতা, জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও মেধাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 
মানব সম্পদ ব্যাবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ কর্যক্রমসমূহ হলো: জনশক্তি নিয়োগ, কর্মীদের শ্রেণী বিভাজন , জনশক্তি উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, বদলী ও পদোন্নতি, প্রেষণা প্রদান, বিনোদন, কর্মী শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, চিকিৎসা সেবা ও কর্মী গবেষণা।

মানবসম্পদ উন্নয়ন, সদ্ব্যবহার, বাছাইকরণ ও নিয়োগবিধি সংক্রান্ত নীতিই হচ্ছে মানব সম্পদ নীতি। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কতকগুলো পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যের সাপেক্ষে নিযুক্ত কর্মীদের থেকে সবার্ধিক কর্ম সম্পাদন লাভ করা। একই কর্মে নিয়োজিত একদল লোককে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় কেউ কেউ ভাল করছে আবার কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম কাজ করছে। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কোন শিক্ষকের ক্লাস থেকে অধিক উপকৃত হয় আবার কোন শিক্ষকের ক্লাস থেকে আশানুরূপ উপকৃত হয় না। সুতরাং ব্যক্তির যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর নির্ভর করে পেষণা নির্ধারণ হওয়া বাঞ্চনীয়।

প্রশিক্ষণ হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কর্মী কর্তৃক কোনো বিশেষ কাজ সম্পাদনের দক্ষতা, যোগ্যতা ও তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। প্রশিক্ষণের কৌশল বা উপায় ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূল লক্ষ্য কর্ম সম্পাদনের আকাঙ্খিত মান অর্জন করা। 

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে দক্ষ মানবসম্পদ বা দক্ষ শিক্ষক তৈরি করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। 


১। সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ: প্রতি তিনমাসে একবার অর্থাৎ বছরে চারবার সকল শিক্ষককে সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বর্তমানে সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ চাহিদার আলোকে প্রদান করা হয়।
২। প্রধান শিক্ষকগণের লিডারশীপ প্রশিক্ষণ: ১৫ দিন মেয়াদী প্রধান শিক্ষকগণের লিডারশীপ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকগণকে প্রশাসনিক এবং একাডেমিক বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। একইসাথে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও এর সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কেও প্রধান শিক্ষকবৃন্দকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
৩। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকবৃন্দকে নির্ধারিত বিষয়ে পাঠদানে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
৪। অটিজম ও একীভুত প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ: একীভুত শিক্ষা বাস্তবায়নে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ।
৫। স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণ: শিশুদের সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষায় প্রশিক্ষণটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ
৬। বাল্য বিবাহ নিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণ: বাল্য বিবাহ ও ইভটিজিং প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত কার্যকরী।
৭। আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকবৃন্দকে আইসিটি বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণটি অত্যন্ত ফলপ্রসু।
৮। গণিত অলিম্পিয়াড বিষয়ক প্রশিক্ষণ: শিশুদের মাঝে গণিতের ভীতি দূর করতে এবং আনন্দের মাধ্যমে গণিত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এটি যুগোপযোগী একটি প্রশিক্ষণ।
৯। বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড বিষয়ক প্রশিক্ষণ: বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা ও জ্ঞান শিশুদের সহজবোধ্য করতে এবং শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণটি চালু করা জরুরী।

শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয় বরং একটি ব্রত। তাই শিক্ষকগণকে সেবাব্রতী মনোভাব নিয়ে আনন্দের সাথে কাজ করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে শিশুর মনোজগতে অনুপ্রবেশ করতে হয়। শিশুর বয়স, চাহিদা, সামর্থ্য ও রুচি এবং সর্বোপরি শিশুদের মন বুঝে কাজ করতে হয়। শিশুদের মন বুঝে তাদেরকে নাচ,গান, খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে লেখাপড়ায় আকৃষ্ট করতে হয়। শিক্ষকগণকে কখনও শিক্ষক, কখনও বন্ধু, কখনও খেলার সাথী এবং কখনও অভিভাবকের ভুমিকা পালন করতে হয়।  

পরিশেষে বলা যায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব পেরিয়ে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ  করেছি। বর্তমান যুগে একটি প্রতিষ্ঠানের মনবসম্পদই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। একটি প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল, উৎপাদনমুখী  ও দক্ষ কর্মীর কোন বিকল্প নেই। সার্বিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, ও দক্ষ জনবল ব্যতীত শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নয়ন ও একটি দেশ ও রাষ্টের দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূল কর্মী হচ্ছে শিক্ষকবৃন্দ। একটি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা যত বেশি তাদের মানবসম্পদ তত বেশি দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। এমডিজি, এসডিজি বাস্তবায়নের সাথে সাথে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদের অন্তর্ভুক্তি ও উন্নয়ন অত্যাবশ্যক।

লেখক: মো: মাসুদুল হাসান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট।

 


আরও পড়ুন