একজন পারুল আপার গল্প : রোজিনা রাখী

news paper

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৬-১১-২০২২ দুপুর ৪:৩৯

23Views

পারুল আক্তার। একজন খুদে ব্যবসায়ী। নিউমার্কেটের নীচ তলায় যেখানে ক্রেতাদের বসার জন্য কয়েকটা স্টিলের চেয়ার রাখা হয়েছে, ঠিক তার সাথেই পারুলের অস্থায়ী ছোট বইয়ের দোকান। সাহিত্য বা নোবেল নয়, তার দোকানে সব ইসলামিক বই এবং ধর্মীয় অনুষঙ্গ যেমন তসবি, টুপি, আতর।

দোকানটা মূলত পারুলের বাবা আমীন উদ্দীনের। বাবা মারা যাবার পর এখন পারুল এই দোকানের সত্ত্বাধিকারী। আমীন উদ্দীন ছেলেবেলায় মাত্র সাত বছর বয়সে বসন্ত রোগে দুচোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও হার মানেননি। আমৃত্যু লড়াই করেছেন জীবন সংগ্রামে। যুদ্ধপূর্ববর্তী সময় থেকেই রাস্তায় হেঁটে বিভিন্ন ধর্মীয় বই-পঞ্জিকা বিক্রি করতেন। দীর্ঘ বছর পর ২০০৩ সালে নিউমার্কেট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আমীন উদ্দিনকে এই জায়গাটিতে অস্থায়ীভাবে বসার অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে শুরু। এর ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বই এনে বিক্রি শুরু করেন। এভাবে এক সময় ব্যবসাটা কোনো রকমভাবে দাঁড় করান। 

পারুল আপা বলছিলেন, যেহেতু আমার বাবা অন্ধ ছিলেন, তাই বাবার একটা শক্ত আর নির্ভরশীল লাঠির দরকার ছিল, আর সেই লাঠিটাই ছিলাম আমি। সব সময় বাবার সাথে সাথে থাকতাম, পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসায় সাহায্য করতাম। যদিও আরো তিন টা ভাই আছে, কিন্তু আমি ছিলাম বাবার খুব কাছের। এইচ এস সি পাশ পারুল কিছুদিন ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ট্রেনিংও নেন স্বাস্থ্যসেবার ওপর।

২০১০ সালে বিয়ে করেন পারুল। তিন সন্তানের মা তিনি। স্বামী চাকরি করতেন বি ডি আর এ লেন্স নায়েক পদে। বর্তমানে তিনি অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। পারুল নিজের সংসার সামলেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাবার পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। বাবার মৃত্যুর পর দোকানের দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝে নেয় মেয়ে পারুল। জানতে চাইলাম পারুল আপার কাছে, আচ্ছা আপনার তো তিন ভাই। আপনি যখন দোকানের ভার নিলেন তখন ভাইয়েরা কিছু বলেনি বা কোনো ঝামেলা হয়নি?
ঝামেলা আবার হয়নি আপা। অনেক ঝামেলা পাড়ি দিয়ে আজ আমি এই দোকানে বসেছি। একটু খুলে বলবেন প্লিজ?        

আব্বা মারা যাবার পর ঢাকা থেকে ট্রাকে করে শরিয়তপুর নিয়ে যাওয়া হয়। আমার ছোট সন্তানের বয়স তখন ১০ দিন। ওই অবস্থাতেই বাড়ি যাই। যে ট্রাকে আব্বার লাশ নেয়া হয়, তার ভাড়া ছিল পাঁচ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়েছিল আমার ফুপু। কবরে আব্বার লাশ নামানোর সময় ফুপু বলেছিল দুনিয়ায় ঋণ থাকলে সেই টাকা শোধ করার ওয়াদা করে দাফন সম্পন্ন করতে হয়। তখন আমি ফুপু কে কথা দিলাম আব্বার এই ঋণ আমি শোধ করবো। আল্লাহর রহমতে শোধ করেও দিয়েছি।
এদিকে দোকান নিতে চায় আমার দুই ভাই। মেঝ ভাই আর ছোট ভাই। বড় ভাই সহজ সরল মানুষ। তার তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। বাধা দেয় মেঝ ভাই বিশেষ করে তার বউ। যেহেতু আমি সব সময় আব্বার সাথে থেকেছি অবশেষে আমিই দোকানের দায়িত্ব নেই। কিন্তু শর্ত হয়, প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা মেঝ ভাইকে আর দুই হাজার টাকা ছোট ভাই কে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত তাই দিচ্ছি।

বড় ভাই দোকানের ভাগ চান নি কেন? বড় ভাই এই দোকানের ভাগ চায় না। বরং সে আমার মাকে দেখাশোনা করে। আচ্ছা পারুল, আপনার বাবা কত টাকার পুঁজি রেখে গিয়েছিলেন? কোনো ঋণ ছিল কি বাজারে? আব্বা প্রায় ৭৮ হাজার টাকার পুঁজি রেখে গিয়েছিলেন। আর ঋণ ছিল ২৮ হাজার টাকা। পুঁজি কি বেড়েছে আগের চেয়ে? জী আপা আল্লাহার রহমতে আর আপনাদের দোয়ায় আমার ব্যবসা আগের চেয়ে অনেক ভালো চলছে। ঋণ শোধ করতে পেরেছেন? হ্যাঁ। কোনো চাঁদা বা বকশিস দিতে হয় কাউকে? না কোনো চাঁদা দিতে হয় না। এই যে ভাসমান দোকান চিন্তা হয় না যদি কখন উঠিয়ে দেয়? হ্যাঁ সে ভয় তো সবসময় হয়। দুঃশ্চিন্তায় থাকি। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত দোকান বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল কেন? তখন কমিটির লোকজন বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার কিভাবে বসলেন?  

এখানে পাঁচ বছর পর পর মালিক সমিতির নির্বাচন হয়। এবার যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা খুব ভালো মানুষ। আব্বার কথা চিন্তা করে আমাকে এখানে আবার বসতে দিয়েছেন। বর্তমানে বেচাকেনা কেমন?আল্লাহর রহমতে বেচাকেনা ভালোই হয়। তবে রমজান মাসে মাশাআল্লাহ অনেক ভালো বেচাবিক্রি হয়। অনেকেই এসে আব্বা কে খোঁজেন। যারা বিদেশে থাকে তারাও দেশে এসে এখানে বই কিনতে আসে, আব্বার খবর নেয়। তখন বুঝতে পারি উনারা আমার বাবাকে খুব ভালোবাসেন। আমার বাবার অছিলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের এই দোকানের বই পৌঁছে গেছে। এটা ভাবলে খুব ভালো লাগে। বই কোথা থেকে পাইকারি কিনে আনেন? বই কিনে আনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাবাজার আর চকবাজার থেকে।
আচ্ছা পারুল আপা, আপনার দোকানের তো কোনো নাম নেই। নাম দিতে ইচ্ছে করে না? অবশ্যই নাম দিতে ইচ্ছে করে আপা। কি নাম রাখবেন আপনার দোকানের? “আমীন বুকস” আমার বাবার নামে। এই দোকান নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? পরিকল্পনা করে লাভ কি আপা, নিউমার্কেটে তো আর কোনোদিন একটা দোকান ভাড়া নিতে পারব না। কত টাকা লাগে একটা দোকান ভাড়া নিতে? একটা ছোট দোকান ভাড়া নিতেও ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিতে হয়।
তাহলে কি এই দোকানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত? হ্যাঁ অনেকটাই অনিশ্চিত। কারো কাছে কিছু বলার আছে দোকান নিয়ে? জি আপা, আমি মাননীয় সরকার প্রধানের কাছে বলতে চাই, এখানকার মালিক সমিতি পরিবর্তন হলেও আমাকে যেন উঠায়ে না দেয়। এই দোকান থেকে আমার পরিবারের অনেকগুলো মানুষের পেট চলে, লেখাপড়ার খরচ চালাই। নিজের সংসার তো চালাই মাকেও দেখি। দোকানটাই এখন একমাত্র সম্বল আমাদের রিজিকের। একজন নারী হয়ে এত মানুষের মধ্যে বসে দোকানদারি করেন আপনার স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কিছু বলে?
নাহ, আমার স্বামী আমাকে কখনো এ নিয়ে কিছু বলে না বরং আরো সাপোর্ট দেয়। আমি বাসায় না থাকলে সেই সময় আমার ছেলে মেয়েকে দেখাশোনা করে। আবার আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলোও অনেক ভালো। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবতী। বাহ শুনে খুব ভালো লাগলো। মার্কেটে এত এত লোকের ভিড় নানা ধরনের মানুষ কখনো কোনো সমস্যা হয় না?
না আপা কখনো কোনো সমস্যা হয় নাই। বরং এরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করে, বোনের মতো দেখে। ওনেক সময় টাকা ভাংতি করে দেয়। এই যে সামনে থালা বাসনের দোকান দেখছেন (হাত উঁচিয়ে) ওই ভাই তো হিন্দু অথচ রমজান মাসে আমাকে উনার কর্মচারীদের সাথে পুরো এক মাস ইফতার করায়। খুব ভালো তো! পারুল আপা, আপনার বাসা কোথায়? বাসা নবাবগঞ্জ? আসা যাওয়া করেন কিভাবে? অনেক সময় রিকশায় আসি আবার হেঁটেও আসি। রাতে কিভাবে ফেরেন? হেঁটেই ফিরি। কোনো ভয় বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন কী? না তেমন কোনো সমস্যা এখনো হয় নাই তবে ভয় তো লাগেই। ঝড় বৃষ্টি শীত গরম সব মাথায় নিয়েই চলতে হয়। তবুও শান্তি নিজে কিছু করতে পারছি। পরিবারকে ভালো রাখতে পারছি।
উদম্য-হার না মানা- সাহসী পারুল আপা সত্যিই এক অনুপ্রেরণার নাম অনেক হেরে যাওয়া মানুষের কাছে। জীবন মানেই যুদ্ধ, জীবন মানেই প্রতি মুহূর্তে স্রোতের বিপরীতে বয়ে চলা হাওয়া। একজন মেয়ে, স্ত্রী, মা এবং বোন হয়েও সব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নিজেকে নারী নয় মানুষ হিসেবে সমাজের সামনে মাথা উঁচু করে। আমরা যারা নারীদের পোশাক নিয়ে কথা বলি, একা নারী দেখলেই খুবলে খেতে চাই তারা এমন একজন পরিশ্রমী নারীকে সম্মান দিতে শিখুন। এদের থেকে শিক্ষা নিন শুধু পুরুষ নয় একজন নারীও পারে সৎ পথে উপার্জন করে সংসার চালাতে সন্তানদের মানুষ করতে।
অন্ধ বাবার একটা লাঠি প্রয়োজন ছিল নির্ভরতার জন্য, সেই বাবার তিনটা ছেলে থাকা সত্বেও একমাত্র মেয়েকেই ভরসা করেছেন সামনে আগাবার জন্য। সেই মেয়েই আগলে রেখেছে বাবার স্মৃতি। স্বপ্ন দেখছে একদিন বড় বড় অক্ষরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে বাবার নাম “আমীন বুকস”।
অর্নবের ভাষায় বলি তবে...
ব্যস্ত শহরে ঠাস বুনোটের ভীড়ে
আজও কিছু মানুষ, স্বপ্ন খুঁজে ফেরে।


আরও পড়ুন