গোয়েন্দাদের নজরদারির আড়ালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হুন্ডি ব্যবসা

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৩-১১-২০২২ দুপুর ১২:১৬

83Views

 দেশের গোয়েন্দাদের নজরদারির আড়ালে নুতন পদ্ধতিতে হুন্ডি ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে লেনদেন করা হচ্ছে। হুন্ডি ব্যবসায় একটি চক্র এমএফএস ব্যবহার করে গত চার মাসেই ৩ কোটি টাকা হুন্ডি করা হয়েছে। এ চক্রের এজেন্টরা প্রতিমাসে ২শ থেকে ৩শ কোটি টাকা লেনদেন করছে।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আলোচিত হুন্ডি ব্যবসায়ীরা রাজধানী ঢাকায় পালিয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল কাজল ওরফে হুন্ডি কাজল। তার সিন্ডিকেটের সদস্য আলমগীর হোসেন। তিনি ১৯৯৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কাজলের হুন্ডি ব্যবসায় যোগ দেন। তার এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে হুন্ডি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ২০০০ সালে হুন্ডি ব্যবসার পতন ঘটলে মানুষের অর্থ ফেরত দিতে না পেরে ১৪ বছর পালিয়ে থাকেন। আলমের মতো কয়েকশ যুবকের শিক্ষাজীবন হুন্ডি ব্যাংকে ধ্বংস হয়। কোটচাঁদপুরের চাঞ্চল্যকর হুন্ডির জের ধরে ঝিনাইদহে জমি দখল, খুনোখুনি, আত্মহত্যার মতো সামাজিক নানা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সেই হুন্ডিধসের ক্ষতের পরও হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না।

জানা গেছে, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা দীর্ঘ দিনের। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি করা হলেও হুন্ডি বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না। দিন দিনই অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বিদেশ গমন, চিকিৎসা ব্যয় মেটানো, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, বৈদেশিক কেনাকাটা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্র এখন হুন্ডির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা লেনদেন সহজীকরণ, ব্যাংকগুলোর নানা সেবামূলক ব্যবস্থাপনাও হুন্ডি বাণিজ্যকে রোধ করতে পারছে না।

সূত্র জানায়, ফ্রিডম ফ্লেক্সি ২৪ডট কম নামের অ্যাপস ব্যবহার করে দেশের গোয়েন্দাদের নজরদারির আড়ালে এই হুন্ডি ব্যবসা করা হচ্ছে। দেশের কুমিল্লা জেলার লাকসামে বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ ‘জে এ এন্টারপ্রাইজ’র দুই হাজার এজেন্ট রয়েছে। আর ওই এজেন্টদের মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রতিমাসেই ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন করা হচ্ছে। আর এই নতুন পদ্ধতি অ্যাপস এর মাধ্যমে হুন্ডি ব্যবসার গডফাদার হচ্ছেন মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (৪২)। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এমএফএসে’র দুই হাজার এজেন্ট সিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। এর দুটি সিম নিয়ে গোয়েন্দারা কাজ করতে গিয়ে আরও ১১টি এজেন্ট সিমের সন্ধান পায়। আর যাদের মাধ্যমে এরকম সন্দেহজনক তথা ডিজিটাল হুন্ডির তথ্য রয়েছে। দুই হাজার এজেন্ট সিমের বেশকিছু এজেন্ট সদস্য হুন্ডির মতো অবৈধ কাজে সরাসরি জড়িত। এমএফএসের এজেন্টদের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যরা বিদেশে স্থানীয় সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচা, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণচোরাচালান, ইয়াবা কারবারসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।

এই চক্রের সন্ধানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মাঠে নামে। একপর্যায়ে হুন্ডি চক্রের ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ ম্যানেজার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (৩৪) কে গ্রেফতার করে। এরপর ঢাকা ও কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে চক্রের অপর ৫ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মীর মো. কামরুল হাসান শিশির (২৮) ফ্রিডম নেট ওয়েবসাইট পরিচালনাকারী। খোরশেদ আলম (৩৪)। মো. ইব্রাহিম খলিল (৩৪), বিকাশ এজেন্ট। কাজী শাহ নেওয়াজ (৪৬), বিকাশ ডিএসও। মো. আজিজুল হক তালুকদার (৪২), বিকাশ এজেন্ট ও বিকাশ এজেন্ট মো. নিজাম উদ্দিন (৩৫)। এদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

সিআইডি সূত্র জানায়, বিদেশি রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি এদেশের অর্থনীতির উপর যে চাপ তৈরী করেছে তা মোকাবেলা করার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর এই ঝুঁকি মোকাবেলায় সিআইডি হুন্ডি কার্যক্রমের উপর নজরদারি শুরু করে। সিআইডি ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহপূর্বক গঋঝ এর মাধ্যমে হুন্ডি পরিলক্ষিত হচ্ছে এরকম প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক এমএফএস এজেন্ট একাউন্টের সন্ধান পায়। সিআইডির ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট ঢাকা ইতঃপূর্বে চট্টগ্রামে যৌথভাবে তিনটি অভিযান চালিয়ে মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করে। তারই ধারাবাহিকতায় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্তে নেমেছে।

মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গ্রেফতাররা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার ও বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আর্নারদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে অর্থপাচার করে আসছে। সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে ওই বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ মূল্যে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। এ কাজে অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে, দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। আর দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী ও তার সহযোগীরা দেশিয় মুদ্রায় ওই অর্থ এমএফএসের এজেন্টকে প্রদান করে। এছাড়া, তৃতীয় গ্রুপ এমএফএসের এজেন্ট কর্তৃক বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত এমএফএসের নম্বরে দেশিয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এই চক্র দুটি প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। গত এপ্রিল মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি চক্র প্রায় ৩ কোটি টাকা হুন্ডি করেছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের মালিকানাধীন কুমিল্লার লাকসামে অবস্থিত বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ জে এ এন্টারপ্রাইজের দুই হাজার এজেন্ট সিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। সিআইডি সন্দেহজনক দুটি এজেন্ট সিম নিয়ে কাজ করে, যার মাধ্যমে গত ৬ মাসে ৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পায়। এই দুটি সিম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এরকম আরও ১১টি এজেন্ট সিমের সন্ধান পায় সিআইডি, যাদের মাধ্যমে এরকম সন্দেহজনক তথা ডিজিটাল হুন্ডির তথ্য রয়েছে। দুই হাজার এজেন্ট সিমের বেশকিছু এজেন্ট সদস্য হুন্ডির মতো অবৈধ কাজে সরাসরি জড়িত। ডিজিটাল হুন্ডির কাজকে সহজ নির্ভুল এবং দ্রুততম উপায়ে সম্পন্ন করার জন্য তারা বেশকিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। 

আরেক সূত্র জানায়, ফ্রিডমফ্লেক্সি ২৪ডটকম এমন একটি সফটওয়্যার যার মাধ্যমে সৌদি প্রবাসী হুন্ডি কারবারিরা বাংলাদেশে যে নম্বরগুলোতে টাকা পাঠানো হবে সেই নম্বরগুলো ইনপুট দিতেন। অপরদিকে বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন এমএফএস এজেন্টদের সহায়তায় বাংলাদেশি হুন্ডির এজেন্টদের মাধ্যমে টাকাগুলো সরাসরি ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে প্রাপকের কাছে যেতো। এমএফএসের এজেন্টদের সহযোগিতায় চক্রের সদস্যরা বিদেশে স্থানীয় সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচা, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণচোরাচালান, ইয়াবা কারবারসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে। আর গ্রেফতারদের কাছ থেকে ১১টি মোবাইল, ১৮টি সিমকার্ড, একটি ল্যাপটপ ও একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আওতায় অনেক ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ আছে। এই ডিস্ট্রিবিউশন হাউজের মালিক ও কর্মচারীদের উচিৎ অধীনস্ত যেসব এজেন্ট আছে তাদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা। যদি মনিটরিং না করে তাহলে তারা আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি বিকাশ, রকেট ও নগদ কর্তৃপক্ষ- যারা ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ অনুমোদন দিয়েছে তাদের ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ অবশ্যই মনিটরিং করবে। তারা যদি মনিটরিং না করেন, তাহলে আমরা বাধ্য হবো তাদের আইনের আওতায় আনতে। প্রবাসীরা যেন তাদের ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠায়। সেক্ষেত্রে দেশের উন্নতি হবে এবং তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে থাকবে না।


আরও পড়ুন