প্রতারণার অভিযোগে হাইকোর্টে দণ্ডিত আইনজীবী খুরশীদ আলম খান

news paper

সাজেদা হক

প্রকাশিত: ২৭-১১-২০২২ দুপুর ১২:২৮

55Views

প্রতারণার অভিযোগে হাইকোর্টে একাধিকবার দণ্ডিত হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। ২৫০০০ টাকা জরিমানাসহ একাধিকবার তাকে সতর্কও করা হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারাও তাকে একাধিকবার সতর্ক করলেও বার বার বিশেষ আদালত, হাইকোর্ট এমনকি দুদককেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। 


ঘটনা (১)

প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, পল্টন থানায় ২০০৭ সালে সড়ক ও জনপদ বিভাগের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল কালাম সামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা দেন। পল্টন থানার সেই কেস নম্বর হলো ৩৬/২০০৭। মজার বিষয় হলো ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের দফায় এবং আবুল কালাম সামসুদ্দিনকে ‘অভিযোগ প্রমাণিত নয়’ মর্মে চিঠি দেয় দুদকের ইনভেস্টিগেশন অফিসার। কিন্তু ২০০৭ সালের জুন মাসের ১০ তারিখে আবারো সম্পদের বিবরণী চেয়ে আবুল কালাম সামসুদ্দিনকে চিঠি দেয় দুদক। একই বছরের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে পুর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা হয়ে নভেম্বরের ১৩ তারিখে পল্টন থানায় ৪ কোটি ৭৬ লাখ ২৪ হাজার ৭৫৭ টাকার আয়বহির্ভুত সম্পদের মামলা (নিজের+স্ত্রী+সন্তান) দেয় দুদক। যার নম্বর হলো ৩৬/২০০৭। বিশেষ আদালত ৬ এ চলমান এই মামলায় দুদকের পক্ষে আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। 

বিশেষ আদালত ৬ এ চলমান এ মামলাটি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন আবুল কালাম সামসুদ্দিন, রিটের নম্বর হলো ১০৩১৩/২০০৭। এখানেও দুদকের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। 

২০০৮ সালের জুলাই মাসের ১০ তারিখে তিনি যুক্ত হন, একই দিনে রিটের শুনানিও শেষ হয়। ওইদিনই রায় ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে, বিচারপতি আব্দুর রশিদ এবং বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের ডিভিশনাল বেঞ্চে একটি এফিডেফিড জমা দেবেন মর্মে দুই দিনের সময় প্রার্থনা করেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী  মো. খুরশীদ আলম খান। সিনিয়র একজন আইনজীবীর আবেদনে সাড়া দিয়ে সরল বিশ্বাসে উক্ত রিটের রায় ঘোষণার তারিখ ২০/৭/২০০৮ নির্ধারণ করেন বিজ্ঞ আদালত। এর মধ্যেই হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে যে এই মামলার রিটটি রায়ের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে-তা না জানিয়ে বিশেষ আদালতে বিচারকাজ চলমান রাখেন। আবার বিশেষ আদালতে যে একই বিষয়ে মামলা চলমান তা উচ্চ আদালতকে না জানিয়ে ‘দুই দিনের সময় প্রার্থনা’ করেন। ১৭/৮/২০০৮ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশনাল বেঞ্চকে দুদকের সিনিয়র আইনজীবী জানান যে, বিশেষ আদালত ৬ এ এই মামলার শুনানী শেষে রায়ও দেয়া হয়ে গেছে। 

সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানের এহেন গর্হিত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং সতর্ক করে বিচারপতি আব্দুর রশিদ এবং বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের ডিভিশনাল বেঞ্চ। এই টাকা কোনো প্রতিষ্ঠান নয় বরং সিনিয়র আইনজীবী নিজেকেই বহন করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। একই সাথে এই ধরনের আচরণকে ‘স্পষ্ট প্রতারণা এবং হাইকোর্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো অপরাধ’ উল্লেখ করে সিনিয়র আইনজীবীকে সতর্ক করা হয়। এ ধরনের আচরণ আর মেনে নেয়া হবে না মর্মে আদেশ দেয়া হয়। আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমরা এর আগে কখনো শুনি নাই যে, রায়ের জন্য বসা হাইকোর্ট বিভাগের প্রসিডিংসকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে আইনজীবীরা এমন প্রতারণার অবতারণা করতে পারেন? এই ধরনের প্রতারণার চর্চা বন্ধ করতেই সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানকে অর্থদণ্ড এবং ভর্ৎসনা করে বিজ্ঞ আদালত।

একই সাথে রিট নম্বর ১০৩১৩/২০০৭ মামলা বাতিল এবং বিশেষ আদালতে কোনো রায় হলে সে রায়ও বাতিল বলে ঘোষণা করে বিচারপতি আব্দুর রশিদ এবং বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের ডিভিশনাল বেঞ্চ।

হাইকোর্টের ডিভিশনাল বেঞ্চের দুই আদেশের বিরুদ্ধে লিভ পিটিশন দায়ের করে দুদক। মামলা বাতিল চেয়ে সিভিল পিটিশন লিভ টু আপীল নম্বর ১৫৩২/০৮ এবং সিনিয়র আইনজীবীর প্রতারণার দণ্ডের বিরুদ্ধে দেয়া আদেশ বাতিল চেয়ে  সিভিল পিটিশন লিভ টু আপীল নম্বর ১৫৬৬/০৮ করে দুর্নীতি দমন কমিশন। আবুল কালাম সামসুদ্দীনের মামলার আদেশ বাতিল চেয়ে আবেদনে দুদকের বাধা না থাকলেও সিনিয়র আইনজীবীর প্রতারণার দণ্ডের বিরুদ্ধে দেয়া আদেশ বাতিল চাওয়ার এখতিয়ার দুদকের ছিলো না। কারণ এটি সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানের প্রতারণার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতের আদেশ, সেটি ব্যক্তিগতভাবে সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানের পিটিশন দেয়ার এখতিয়ার। তারপরও কৌশলে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই পিটিশনটিও দায়ের করিয়েছেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। এটিও এক ধরনের প্রতারণা। 

যদিও এই সিভিল পিটিশন লিভ টু আপীলের মামলা নম্বর ১৫৩২/০৮ খারিজ এবং পিটিশন লিভ টু আপীলের মামলা নম্বর ১৫৬৬/০৮, অর্থদণ্ড মাফ করে, এ ধরনের প্রতারণার যেন আর না হয়-বলে ভর্ৎসনা এবং সতর্ক করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন আপীল বিভাগ। 

ঘটনা (২)

দুদক আইনের ১২ (২) ধারা বাতিল চেয়ে জনস্বার্থে রিট ৫৫০৩/২০১৫ দায়ের করা হয়। সেই রিটে ব্যক্তিগতভাবে ৬ নম্বর রেসপন্ডেন্ট ছিলেন দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান, ৭ নম্বর রেসপন্ডেন্ট কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এবং ৮ নম্বর রেসপন্ডেন্ট উপপরিচালক নাসির উদ্দিন। এই রিটে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয় নাই। কিন্তু ৬ নম্বর রেসপন্ডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে রিটের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেন দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানকে। আর রিটের পক্ষ নেন ৭ এবং ৮ নম্বর রেসপন্ডেন্ট এবং তারা কোনো আইনজীবী দেবেন না বলে মত প্রকাশ করেন।  

সেই রিটের রায়ে ১২ (২) ধারা বাতিল হলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান রায়ের বিরুদ্ধে ৬ নম্বর রেসপন্ডেন্ট হিসেবে আবার আপীল নম্বর  সিপিএলএ ৩৬৬৮/১৫ দায়ের করেন। সেই আপীলের শুনানিতে অংশ নেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানের স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ফলে দুদকে পিটিশনারের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আবেদন জানিয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বরাবর আবেদন করেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। অথচ ৬ নম্বর রেসপন্ডেন্ট তার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এটি চলছিলো। 

এটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক এই মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলো না। তার প্রেক্ষিতে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ‘ আই ডোন্ট হ্যাভ এনি পার্সোনাল ইন্টারেস্ট ইন দিস ইস্যু’ মর্মে তাৎক্ষণিক ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। যার ফরে বিজ্ঞ আইনজীবী উক্ত সিপিএলএ ৩৬৬৮/১৫-তে পিটিশনার প্রতিস্থাপন করতে পারেননি। ফলে কোনো লুকাস স্ট্যান্ডি নেই মর্মে আপীল বিভাগ গত ২১/৭/২০১৬ তারিখে সিপিএলএ ৩৬৬৮/১৫টি ডিসমিস করেন। 

কিন্তু ১০/৯/২০১৮ তারিখে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ আবারো ‘এটি সত্য যে আমি ব্যক্তি হিসেবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না কারণ নতুন হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়টি আমলে আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন দেখছি ইন্সটিটিউশন হিসেবে এবং এন্টি করাপশন কমিশন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে স্বার্থ রয়েছে। ন্যায় বিচার এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে রিভিউ বা আপীল বা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মো. খুরশীদ আলম খানকে দায়িত্ব প্রদান করুন মর্মে দুদকের সংশ্লিষ্ট শাখায় জানান। পরে সংশ্লিট শাখা পূর্বের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেন। 

এখানেও রেসপন্ডেন্ট ৬ এ মো. বদিউজ্জামানের স্থলাভিষিক্ত হন দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এবং ইকবাল মাহমুদের ব্যক্তিগত আইনজীবী হয়ে ওঠেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। 

 


আরও পড়ুন