কুড়িগ্রামে একটি বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় উপস্থিতি শিক্ষার্থীর চেয়ে উপবৃত্তির শিক্ষার্থীই বেশি

news paper

রাজারহাট প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৫-১২-২০২২ বিকাল ৫:১৫

11Views

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির শিক্ষার্থীর চেয়ে উপবৃত্তির শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বিদ্যালয়ের ৬জন শিক্ষক,২জন স্টাফসহ ১৬জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে পরীক্ষা। বিদ্যালয়ের খাতা-কলমে ভর্তি ৬ষ্ট থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ১১২জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার ১ডিসেম্বর সকালে সরেজমিনে দেখাযায়, বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষক রোদ পোহাচ্ছে আর বিদ্যালয়ে ইংরেজি২য় পত্রে ৭ম শ্রেণীতে ৫জন ছেলে ও ২জন মেয়ে এবং ৮ম শ্রেণীতে শারিরিক শিক্ষা বিষয়ে ৬জন ছেলে এবং ৩জন মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন। এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে কোন পরীক্ষার্থী নেই। পরীক্ষা কক্ষে কোন শিক্ষক নেই। বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতা অনুযায়ী ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে-৩২জন,৭ম শ্রেণীতে-৪০জন এবং ৮ম শ্রেণীতেও ৪০জন শিক্ষার্থী রয়েছে। 

এদের মধ্যে ১৮জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে। আর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ ৬জন শিক্ষক,অফিস সহকারি এবং পিয়নসহ ৮জন স্টাফ রয়েছেন। ৮ম শ্রেণীর পরীক্ষার্থী নাইম বলেন,আমাদের শ্রেণীতে ১৫জন শিক্ষার্থী আছে। এরমধ্যে ঢাকায় কাজ করতে গিয়ে ৩জন মারা গেছে। দু’জন ঢাকায় কাজ করছেন এবং একজন বাড়িতে আছে। আর আমরা বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছি ৬জন ছেলে এবং ৩জন মেয়ে।

আরেক ছাত্রী মিথিলা বলেন,আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি ৯জন। করোনার পর কেউ কেউ ঢাকা গেছে,কেউ বাড়িতে আছে আবার অনেকেই অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থী কম। পরীক্ষার্থী ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া আক্তার সুমি বলেন,আমরা ৭ম শ্রেণীতে ইংরেজি ২য় পত্রে পরীক্ষা দিচ্ছি মাত্র ৭জন। এরমধ্যে ৫জন ছেলে এবং ২জন মেয়ে।

শিক্ষার্থী কম হবার বিষয়ে অনুসন্ধানে জানাযায়, উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের একমাত্র বিদ্যাপীঠ বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালে স্থাপিত হয়। ওই বছরেই বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হয়। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে ২০১৭সালে ওই ইউনিয়নের তৈয়বখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কিছু দিন পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু নতুন জায়গা না পাওয়ার অযুহাতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকনাথ বর্মনসহ কয়েকজন শিক্ষক রাতের আধারে বিদ্যালয়টি উপজেলার পার্শ্ববর্তী নাজিমখাঁ ইউনিয়নের তালতলা
রঞ্জিতসর গ্রামে স্থানান্তর করেন। 

অন্য ইউনিয়নে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করায় বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চরসহ আাশে পাশের নিম্ন মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অপর দিকে বর্তমান স্থানে থাকা বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিন কিলোমিটারের মধ্যে কালিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়,ডাংরারহাট উচ্চ বিদ্যালয়,নাজিমখাঁ উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাছড়া আজিজিয়া আলিম মাদ্রাসা রয়েছে। ফলে বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হওয়ায় বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের বিদ্যানন্দ সরকারি

প্রাথমিক বিদ্যালয়,পশ্চিম চর বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,চর তৈয়বখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,রতিদেব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,চর রতিদেব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ চর তৈয়বখাঁ ও হয়বতখাঁ এনজিও পরিচালিত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পার্শ্ববর্তী রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের মধুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দু’ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এসব বিদ্যালয়ের আশেপাশে কোন ৬/৭ কিলো মিটারের মধ্যে কোন নিম্ন বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।

রতিমারী গ্রামের বাসিন্দা নছর উদ্দিন বলেন,আমি এলাকার সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয়ের জায়গায় দেবো। তবু চাই হামার ইউনিয়নের স্কুল হামার এটে থাকুক। তেয়বখাঁ গ্রামের বাসিন্দা আজাহার আলী বলেন,হামার চরের এলাকায় কোন স্কুল না থাকায় প্রাইমারী পাশ করে মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেয় অভিভাবকরা। আর ছেলেরা চরের মধ্যে কামলা দেয়,ঢাকা যায়। এই এলাকার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কুলটি আমাদের এখানে পুনরায় আনা হোক।

শ্রীমতি কমলা রাণী বলেন,বর্তমান হামার ইউনিয়নের স্কুলটি অন্য ইউনিয়নে থাকায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের সুযোগ সুবিধা হইছে। তারা বসে বসে সরকারের বেতন ভাতা তুলছে। অথচ আমাদের এখানে স্কুল না থাকায় বাচ্চাদের পাশের স্কুল গুলোতে ভর্তি করানো হচ্ছে। আমাদের চর ও গ্রামের সন্তানদের পড়ালেখা নিশ্চিত করতে সরকার দ্রুত স্কুলটি ফিরিয়ে দেক। ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী আলোমনি জানান,নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় আমিসহ এলাকার অনেকেই দূরের স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছি। নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় অনেকেই পড়াশোনা বাদ দিয়েছে।

বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র মৌলবি শিক্ষক মামুনুর রশীদ বলেন,নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হবার পর বিদ্যালয়টি এখানে স্থানান্তর করা হয়। শিক্ষার্থী কম হবার বিষয়ে তিনি জানান বাল্যবিয়ের প্রভাব না পড়লেও করোনা পরবর্তিতে ছেলেরা কর্মমুখী হওয়ায় ঝড়ে পড়াকে দায়ী করেন। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকনাথ বর্মন ফোনে বলেন, আপনাদেরকে সঠিক তথ্য দেয়া হবে না বলে ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।

এই বিষয়ে বিদ্যানন্দ ইউপি চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলাম বলেন, এই ইউনিয়নে ১৯৯১ সালে চর বিদ্যানন্দ এলাকায় বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ৯৯শতক জায়গায় স্থাপিত করা হয়। পরে ২০১৭সালে বিদ্যালয়টি নদী ভাঙ্গনের কারণে জায়গায় নির্ধারণ করার আগেই প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন রাতারাতি বিদ্যালয়টি নাজিমখাঁ ইউনিয়নে স্থানান্তর করেন। এই বিষয়ে মিটিং করা,লিখিত অভিযোগসহ প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোন লাভ হয়নি। 

বর্তমানে যেখানে স্কুল আছে সেখানে নামমাত্র ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে চললেও আমার এলাকায় স্কুল না থাকায় শত- শত ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ নদীর ওপারে বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সেখানকার শিক্ষকরা নিয়মিত নদী পার হয়ে পাঠদান করাচ্ছেন। আর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাদের সুবিধার জন্য বাঁচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দিয়ে অর্থ অপচয় হচ্ছে।

এই বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফ-উজ-জামান সরকার বলেন, আমি পরিদর্শনে গিয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ২০/২২জন শিক্ষার্থী পেয়েছি। এই বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি। এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম বলেন,বিদ্যানন্দ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে নিয়ে যাবার জন্য আমরা চেষ্ঠা চালাচ্ছি।


আরও পড়ুন