মিয়ানমারের ধন্যবাদ ও বাংলাদেশের প্রত্যাশা

news paper

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ১১-১-২০২৩ বিকাল ৫:২৯

21Views

এই বছর ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে মিয়ানমার। এ উপলক্ষ্যে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বাংলাদেশ, ভারতসহ কয়েকটি দেশকে বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইতিবাচক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ায় তিনি এসব দেশকে ধন্যবাদ জানান। সেখানে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং তার দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য কিছু দেশের সমালোচনা করেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ায় চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দেন তিনি। নানা সমালোচনা, চাপ, হামলার মধ্যেও এসব দেশ ও সংগঠন আমাদের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী বা উদ্বাস্তু বলতে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬,৫৫,০০০ থেকে ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩,০০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।  

বাংলাদেশের মত একটা সীমিত আর্থিক সামর্থের দেশ এই মানুষ গুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে কি নিদারুণ অত্যাচার হয়েছে তা আমাদের কম বেশি সবারই জানা। পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের উত্তর ভাগে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা; যাদের বেশিরভাগেরই ধর্ম ইসলাম। তারা মিয়ানমার এর সামরিক জান্তা ও উগ্র রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে তারা নিজেদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে তাদের জন্য সাধ্যমত এক ব্যবস্থা করেছে ভাসানচরে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থান দেওয়া  চারটি খানি কথা নয়, বরং এটি একটি ব্যাপক মহৎ উদ্যোগ। যদিও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়ার অর্থ তাদের সেখানে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা নয়। যদি তাদের সেখানে বা কুতুপালংয়ে বা কক্সবাজারের অন্যান্য জায়গায় বা বাংলাদেশের অন্য কোথাও স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়, তার অর্থ দাঁড়ায় মিয়ানমারের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে কোন নৃগোষ্ঠীর এরকম লাখ লাখ মানুষকে কোন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা মোটামুটি একটি বিরল ঘটনা। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময়ে নানা মত দিয়ে আসছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি এই রোহিঙ্গা সমস্যার। কোনো উদ্যোগেই কাজ হয়নি, বরং বাংলাদেশের ওপরেই চাপ বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু বাংলাদেশ ছোট্ট একটা উন্নয়নশীল দেশ হয়েও এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা সব ব্যবস্থা করে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় অথচ বাংলাদেশে যখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য কিছু আশ্রয়, খাদ্য বস্ত্রের ব্যবস্থা করছে তখন তারা এ ব্যাপারে বিভিন্ন উচিত-অনুচিতের বুলি আওড়াচ্ছেন যা বাস্তবতা বিবর্জিত। 

অন্যদিকে ভাসানচরে রোহিঙ্গারা পাচ্ছে নিজেদের জন্য আলাদা ঘর, রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি, পয়নিষ্কাশন সুবিধা। সেই সাথে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এমনকি পশুপালন ও কৃষি কাজের মাধ্যমে সেখানে জীবিকা নির্বাহেরও সুযোগ রয়েছে যা তাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। কক্সবাজারের ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে সরকারকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। এখানে ১২০টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছগ্রাম রয়েছে যার প্রতিটিতে রয়েছে বারোটি করে হাউজ। প্রতিটি হাউজে রয়েছে ষোলটি করে কক্ষ যার প্রতিটিতে চারজন এর একটি পরিবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য ঘরগুলোকে উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে এবং উঁচু বেড়ি বাঁধও তৈরি করা হয়েছে। এটা হয়ত কেউ দাবি করবে না যে ভাসানচরে সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের মানদন্ডের সাথে তুলনীয়। কিন্তু এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষের থেকেও ভাসানচরে যে বেশি সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটা বলা অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের মতো ছোট্ট এদেশে ১১ লাখ লোককে আশ্রয় দেওয়া সত্যিই এক চ্যালেঞ্জ এর মত। কিন্তু আমরা যদি আমাদের আর্থিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা শুধু চিন্তা না করে মানবিকতার কথা চিন্তা করি, তবে আমরা রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার সমব্যথী না হয়ে পারি না। আমাদের স্মৃতি যদি গোল্ডফিশের মত সীমিত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে আমাদের প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

বার্মার সামরিক বাহিনীর হাতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত এবং চলমান সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বার্মা থেকে বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বার্মা থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য ১.৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। তাৎক্ষণিক মৌলিক চাহিদাগুলোকে সমর্থন করার পাশাপাশি শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগের উন্নতির মাধ্যমে শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর সহনশীলতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে শক্তিশালী করে সরকারের মানবিক সহায়তা। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং এই নৃশংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের বাস্তবতা বিবর্জিত একটি মানদন্ডের রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধাকে তুলনা করে এর বিরোধিতা করা সমীচীন হবে। আর সর্বোপরি, রোহিঙ্গারা যেন তাদের নিজেদের দেশে, নিজেদের গৃহে ফিরতে পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাদের নিজ বাসভূমে সম্মানের সাথে প্রত্যাবর্তন করতে ব্যর্থতার অর্থ হবে প্রকারান্তরে মায়ানমারের অন্যায় কে প্রশ্রয় দেওয়া। এই বিষয়টি তাই শুধু রোহিঙ্গাদের বা বাংলাদেশের বিষয় নয়; বিশ্বশান্তি নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নও বটে। জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত এসব রোহিঙ্গাকে স্বভূমিতে ফেরাতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। পরে চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি হয়েছিল। তবে এই সংকটের চার বছরেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। উল্টো রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন এখনো অব্যাহত রয়েছে।  

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপুল সংখ্যাক শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের একটি বোঝা। এই রোহিঙ্গা শরনার্থী নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে উদ্ভূত নানামুখী বাস্তবতা মোকাবিলা করে চলতে হচ্ছে। আজ এসব শরনার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যপারে মিয়ানমারের সমাহীন পিছুটান। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই মানবিকতার কারনেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে। এ সংকটের সমাধান হওয়া অতীব জরুরী। তা না হলে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আছে নানা চ্যালেঞ্জও। বাংলাদেশ সরকার খুব দ্রুত এ সংকটের সমাধান চায়। মিয়ানমার সরকার শুধু ধন্যবাদ দিয়ে নয় তার বাস্তব সমাধান দ্রুততার সাথে করবে এটাই বিশ^বাসীর কাম্য। 


                                                                                                                                                                                  লেখক: ট্রেজারারবরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
 


আরও পড়ুন