ফারজানা বাতেন

  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  প্রিয় খাবার

news paper

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৮-৫-২০২৩ বিকাল ৫:৩৩

257Views

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার প্রিয় কবি। তাঁর জন্মজয়ন্তীতে তাঁর প্রিয় খাবার এবং খাদ্য দর্শন নিয়ে আমার জানা বিষয় সবার সাথে শেয়ার করছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ভোজন রসিক মানুষ। নানা রকমের নানা ধরণের খাবার খেতে ও এক্সপেরিমেন্ট করতে তিনি বরাবর পছন্দ করতেন। কাবাব নোসি থেকে আনারস দিয়ে মাটন, কি ছিল না তাঁর পছন্দের তালিকায়? চলুন দেখে নেওয়া যাক রবি ঠাকুরের কিছু প্রিয় খাবারের তালিকা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পছন্দের নিরামিষ খাবার
ঠাকুর বাড়ির আদরের রবি ছোটবেলা থেকে আমি, নিরামিষ দুই ধরণের খাবার খেতেই পছন্দ করতেন। তবে নিরামিষের দিকে টান ছোটবেলায় বেশি ছিল। সোনা মুগের ডাল ছিল তাঁর অন্যতম পছন্দের খাবার তবে তাতে সজনে ডাটা হলে বেশ জমতো। এছাড়া ফুলকপি দিয়ে তৈরী নানান পদ, নারকেল বাটা দিয়ে ইঁচড়, পাঁচ ফোঁড়ন সহযোগে নিরামিষ তরকারি, লুচি সাদা আলু দিয়ে, দুধ শুক্তো, ঝিঙে পোস্ত, কলার মোচার কোপ্তা, কখনো সখনো সন্দেস, কলা, দুধে ফেলে মেখে খেতেন। বাঙালি খাবার তাঁর পছন্দের ছিল সেটা বলা বাহুল্য। আরও কত কি? লিখে শেষ করা যাবে না।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পছন্দের আমিষ খাবার
আমিষ পদের মধ্যে তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল চিকেন কাবাব নোসি, সুরতি মিঠা কাবাব। মাছের পদের মধ্যে কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছের মুঠে, নারিকেল চিংড়ি, আদা দিয়ে মাছের ঝোল, রুই মাছের কালিয়া। তবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের মাটনের পদ ছিল ইঁচড় দিয়ে কচি পাঁঠার মাংস। কৈ মাছের তরকারি, চিতল মাছের পেটি ভাজা খেতে খুব ভালোবাসতেন তিনি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পছন্দের বিদেশী খাবার
ব্রিটিশ নানা রকমের পদ, আপেল দিয়ে রান্না খাসীর মাংস, তুর্কী কাবাব, প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল। আনারস দিয়ে মাটন বিদেশ থেকে খেয়ে এসে ঠাকুর বাড়িতে বানানোর আদেশ দেন। খুব পছন্দ করতেন তিনি এটি। এছাড়া চিংড়ির কাটলেট, হ্যাম প্যাটি, কন্টিনেন্টাল ফ্রুট স্যালাড, জাপানি চা ইত্যাদি।

মিষ্টি মুখে কি পছন্দ করতেন কবিগুরু 
নারিকেল দিয়ে তৈরি মিষ্টি,পায়েস, চন্দ্রপুলি, ক্ষীর, দই দিয়ে বানানো মালপোয়া, চিড়ের পুলি, মানকচুর জিলিপি, আমসত্ত্ব খেতে খুব ভালবাসতেন। পায়েস ও পিঠে পুলি খেতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

কবিগুরুর পছন্দের ফল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফল খেতে পছন্দ করতেন। মওশুমি ফল মোটামুটি সবই তিনি খেতেন। তবে বিশেষ করে পাকা পেঁপে, কলা, বাতাবি লেবু,আম ছিল তাঁর বেশি পছন্দের। আম ছিল রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় ফল। বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাস এলে রবীন্দ্রনাথ খুবই খুশি হয়ে উঠতেন। তিনি আম চুষে চুষে খেতে পছন্দ করতেন। আম কেটে খাওয়া ছিল তাঁর অপছন্দের।। 

শোনা যায়, তিনি নাকি জাপান যাওয়ার সময় আম সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একবার অসুস্থ হয়ে আমেরিকা যাওয়ার সময় মুম্বাই বন্দর থেকে এক বাক্স আলফানসো আম কিনেছিলেন তাঁরা। 
সে তো গেল ফল। এবার আসা যাক রান্না করা খাবারের তালিকায়। 
লেখক বনফুল স্বপরিবার গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের সময়ে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন স্ত্রীর বানানো সন্দেশ। রবীন্দ্রনাথ বনফুলের হাতে সন্দেশের বাক্স দেখে বললেন, এটি কী? বনফুল বললেন, সন্দেশ। তিনি কৌটাটি খুলে রবীন্দ্রনাথের সামনে রাখলেন। রবীন্দ্রনাথও একটি সন্দেশ মুখে দিয়ে বিমোহিত হয়ে গেলেন। সন্দেশ খেতে খেতে বললেন, ‘বাংলাদেশে তো দুটি মাত্র রস-স্রষ্টা আছে। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ যে তৃতীয় লোকের আবির্ভাব হল দেখছি।’
সেই একই সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বিকেলে দেখা করতে বললেন। বললেন, ‘তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড় বড় কাবলি মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটি লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে। কী বল?’

বনফুলের সম্মতি না জানানোর কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সূক্ষ্ম রসবোধ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। বনফুলের লেখা পড়েই কি তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে বনফুল ঝাল খেতে পছন্দ করেন? বনফুল কোথাও না কোথাও রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেছিলেন। সেটা তাঁর নজরে পড়েছিল। সেদিনই তিনি বনফুলকে বলেছিলেন, ‘তোমার নাম হওয়া উচিত ছিলো বিছুটি। যা দু’-এক ঘা দিয়েছো, তার জ্বলুনি এখনও কমেনি।’
রবীন্দ্রসাহিত্যে কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায়, জীবনীতে তাঁর খানাপিনা নিয়ে ভাবনার অনেক কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু খুব কম জায়গায় পাওয়া যায় তাঁর খাদ্যদর্শন।
বনফুলের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথও সে কথা লিখেছেন। ইন্দিরা দেবীও মোটামুটি কাছাকাছি কথাই লিখেছেন। তবে তাঁর খাদ্যদর্শনটি ধরতে পেরেছিলেন সম্ভবত রথীন্দ্রনাথই। 
রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার কথা মনে আছে? এর সভ্যরা প্রতি মাসে নিজেদের বাড়িতে সভার আয়োজন করতেন পালাক্রমে। সেখানে গান-কবিতা-অভিনয় ছাড়াও প্রচুর আড্ডা হতো। তার সঙ্গে চলত খাওয়াদাওয়া। বেশ কয়েকবারই রবীন্দ্রনাথের পালা পড়েছিল নিজের বাড়িতে আড্ডা বসানোর।

রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সেবার যেবার নিমন্ত্রণ করার পালা পড়ল, বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। মাকে ফরমাশ দিলেন খাওয়ানোর সম্পূর্ণ নতুন রকম ব্যবস্থা করতে হবে। মামুলি কিছুই থাকবে না। প্রত্যেকটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকা চাই।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘বাবা মনে করতেন খাওয়াটা উপলক্ষ মাত্র। রান্না ভালো হলেই হলো না, খাবার পাত্র, পরিবেশনের প্রণালী, ঘর সাজানো, সবই সুন্দর হওয়া চাই। যেখানে খাওয়ানো হবে তার পরিবেশে শিল্পীর হাতের পরিচয় থাকা চাই। মা রান্নার কথা ভাবতে লাগলেন, অন্যরা সাজানোর দিকে মন দিলেন।’
একই রকম বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল। সেই যে বেশি করে লঙ্কা দিয়ে ঘুগনি খাওয়ার সময় যেদিন, সেদিন মূলত রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে বনফুলের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উত্তরায়ণের একটি বারান্দাকে পর্দা দিয়ে ঘিরে খাবারের আয়োজন করেছিলেন। অদ্ভুত সে আয়োজনের বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল। বনফুল জানাচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের পেছনে এমনকী তাঁর দেড় বছরের ছেলের বসার আসনের পেছনেও দাঁড়িয়েছিলেন একজন করে তত্ত্বাবধায়ক। খাবার নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কিন্তু খাবার নিয়ে এই যে আয়োজন, সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের খাদ্যদর্শন। 
এছাড়া  ও জানা যায়,  ১৯১২ সালে "গীতাঞ্জলী "র ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল গ্রীন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অফ টমেটো স্যুপ, স্যামন ইংল্যান্ডের সস অ্যান্ড কিউকাম্বার, প্রি সল্টেড ল্যাম্ব উইথ গ্রীন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রীন সালাদ ও আইসক্রিম।  

এখন শেষ  করবো আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সারাদিনের খাবারের রুটিন দিয়ে, যা আমি জেনেছি বিভিন্ন বই পড়ে। 
‘দেশে ও বিদেশে নানা ধরনের খাবার খেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শেষ পাতে মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী খুব ভালো রান্না করতেন। তাঁর রান্না খেয়ে গুরুদেব অনেক প্রশংসা করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকা অনেক শিক্ষকের স্ত্রীরা অনেকটা প্রতিযোগিতা করে তাঁর জন্য রান্না করতেন।

প্রতিদিন সকালে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্লাস নিমপাতার রস খেতেন। আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ প্রায়ই রান্না করে আনতেন তাঁর জন্য। পায়েস বা বাদামজাতীয় মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন। 

রবীন্দ্রনাথ সারাদিনে বেশ কয়েকবার খেতেন। তিনি ভোরবেলায় খুব তাড়াতাড়ি উঠে পরতেন। তাঁর দিনের শুরু হতো এক কাপ চা অথবা কফি খেয়ে। একটু বেলা হয়ে প্রাতঃরাশে ভেজা বাদাম, মধু সহযোগে টোস্ট এবং এক কাপ দুধ। আবার মাঝে মাঝে তাঁর ছোটবেলার প্রিয় খাবার সন্দেশ, কলা, দুধে ফেলে মেখে খেতেন। এর পর সকাল দশটা নাগাদ তিনি লেবুর রস খেতেন এবং মধ্যাহ্ন ভোজনে রবীন্দ্রনাথ ভাত খেতেন, তবে তিনি
ভাত খুব অল্প পরিমাণে খেতেন। বিকেলে কবির জন্য বরাদ্দ ছিল মুড়ি ও চা। কবির রাতের খাবারে থাকত সব্জির স্যুপ কয়েকটি লুচি ও তরকারি। রবীন্দ্রনাথ দুপুরের খাবার পরিবারের সবার সাথে ঘরের মেঝেতে বসে খেতেন। কিন্তু রাতের বেলায় তিনি খেতেন ডাইনিং টেবিলে বসে।’


আরও পড়ুন