কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু চক্র, নকল ওষুধ তৈরি চক্রের ৮জন গ্রেফতার

নকল ওষুধে বাজার সয়লাব

news paper

মহসীন আহমেদ স্বপন

প্রকাশিত: ১৭-৮-২০২১ বিকাল ৭:৪

35Views

 ওষুধ। জীবনরক্ষা করে। মানুষকে মুক্তি দেয় অসুস্থ্যতা থেকে। রোগ সংক্রমণের ব্যাপকতায় বেশ কিছু ওষুধের চাহিদাও বাজারে বেশ। গ্যাস্ট্রিক, প্রেসার ডায়াবেটিস, কিডনী রোগের ওষুধ অন্যতম। অতি মুনাফার লোভে এইসব ওষুধই নকল করছে জালিয়াত চক্র। গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি পেতে আপনি যে সেকলো নামের ওষুধ খান, তা কি আসল ব্র্যান্ডের? কিংবা একই রোগের এন্টাসিড সিরাপ ভেজাল নয় তো? বাজারে এমন চাহিদা সম্পন্ন বেশ কিছু ওষুধ নকল করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিশেষ চক্র। আছে ইউনানী ওষুধের লাইসেন্স নিয়ে এ্যালোপ্যাথি ওষুধ বানানোর হিড়িকও। মেশাচ্ছে রং ও ঘণচিনি। এসব ওষুধই ছড়াচ্ছে অলিগলি কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসীগুলোয়। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে ভোক্তাদের।

মানুষের জীবন রক্ষায় বহুল ব্যবহৃত মন্টিলুকাস্ট, ওমিপ্রাজল ও সেফিক্সিম গ্রুপের নকল ওষুধ তৈরি করে বিক্রি করত একটি চক্র। আর এ সব নকল ওষুধের কারণে কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ্বসনতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।নকল ওষুধ তৈরির এই চক্রের ৮জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের গোয়েন্দার (ডিবি) একটি দল।

গ্রেফতাররা হলেন- ফয়সাল মোবারক, নাসির, ওহিদুল, মামুন, রবিন, ইব্রাহিম, আবু নাঈম ও ফয়সাল। এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় নকল ওষুধ তৈরির মেশিন ও বিপুল পরিমাণ ওষুধ। তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা করা হয়েছে।এগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেফ-৩ নামের নকল ওষুধের ১৬ বক্স, যাতে ট্যাবলেটের পরিমাণ ২২৪ পিস। এছাড়া সেকলো-২০ নামের ১৬ বক্স নকল ওষুধ, যাতে রয়েছে ১৯২০ পিস ট্যাবলেট। আর ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মনটেয়ার ১০ নামের নকল ওষুধের ২২ বক্স, যাতে ট্যাবলেটের পরিমাণ ৬৬০ পিস।
আরও রয়েছে- জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসের ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস নামের নকল ওষুধের ৮০০ বক্স, যাতে রয়েছে ২৪০০০ পিস ট্যাবলেট। দি একমি ল্যাবরেটরিসের মোনাস ১০ নামের নকল ওষুধের ৪০ বক্স, যাতে ১২০০ পিস ট্যাবলেট রয়েছে। এছাড়া রয়েছে নকল ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট।
সোমবার (১৬ আগস্ট) ডিবি কার্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, একটি অসাধু চক্র এ অতিমারিতে নকল ওষুধ বাজারজাত করছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানী, সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্প এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে এ প্রতারক চক্রের ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিবি প্রধান আরও বলেন, চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার ফয়সালের নামে সাভার ও পিরোজপুরে দুটি কারখানা রয়েছে। সে ভুয়া ড্রাগ লাইসেন্স নিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছিল। ফয়সাল মূলত আতিয়ার নামে এক কেমিস্ট্রির কাছ থেকে বাজারে ব্যাপক প্রচলিত নামিদামি ব্র্যান্ডের ওষুধের ফর্মুলা ও কম্পোজিশন নিত। এরপর মিটফোর্ডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী মুহিবের কাছ থেকে কেমিক্যাল সংগ্রহ করে এসব ওষুধ তৈরি করত তার কারখানায়। নকল ওষুধ তৈরির পর মিটফোর্ডের কয়েকটি গ্রুপ এসব নকল ওষুধ বাজারজাত করত।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার নাঈম নকল ওষুধের জন্য সব প্যাকেট তৈরি করত। আর গ্রেফতার ফয়সাল, নাসির, ওহিদুল, মামুন, রবিন, ইব্রাহিম, আবু নাঈম, ফয়সাল ও তাদের সহযোগীরা তৈরিকৃত এ সব নকল ওষুধ বাজার মূল্যের চেয়ে নামমাত্র দামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করত। তারা নকল ওষুধ প্রেরণ করত ইউএসবি কুরিয়ার, এসএ পরিবহন, সুন্দরবন কুরিয়ারসহ বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, নন ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রেডের এসব কেমিক্যাল সেবনের ফলে মানুষের কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ্বসনতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, সারাদেশে এলোপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও হোমিওপ্যাথিকসহ ৮শ’র বেশি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও এদের মধ্যে প্রায় ৭শ’ প্রতিষ্ঠান নকল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। ফলে রোগীরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি গুরুতর শারীরিক সমস্যার শিকার হচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৮ থেকে ১০ টাকার জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ ডিপো প্রোভেরার কর্ক ও লেবেল বদলে ডিপোমেট্রাল নামে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। নকল করা হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে ব্যবহারের কেভিনটল ট্যাবলেট। নকল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হাইড্রোকরটিসন ইনজেকশন। নকল হচ্ছে অসটিওআর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্য ব্যবহারের মিথাইল প্রেডনিসোলন গ্রুপের একটি ইনজেকশন।


এছাড়া বিভিন্ন তরল ওষুধেরও নকল হচ্ছে অহরহ। বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওষুধ। জ্বরের ওষুধ চাইলেই দেওয়া হচ্ছে উৎপাদন নিষিদ্ধ ওষুধ নিমোসুলাইড। আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রফিকেক্সিব গ্রুপের ওষুধও বিক্রি হচ্ছে।চিকিৎসকদের মতে, এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক এমোক্সিসিলিন ড্রাই সিরাপের বোতলে দামি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাই সিরাপের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। নকল হচ্ছে যক্ষ্মা রোগের ওষুধ রিফিমপিসিন ট্যাবলেট। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, এ ট্যাবলেটের মধ্যে রাসায়নিক কোনো উপাদান নেই। শুধু ময়দা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এ ওষুধ। কিডনি ও ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহারের ইপরেক্স ইনজেকশন এবং এর অ্যাম্পুলেও নিম্নমানের উপাদান ধরা পড়েছে। অথচ ওষুধ বিধিতে বলা হয়েছে, ইনজেকশন ভায়ালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে অ্যাম্পুল সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু তা মানছে না কোনো কোম্পানি। খুচরা বাজারে এই পানি বা অ্যাম্পুল বিক্রি হচ্ছে। ফলে ওষুধ ঠিকমত কাজ না করায় বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসকেরা।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিটফোর্ডে পাইকারি ওষুধের বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ন্যাশনাল ড্রাগস লি., বেনহাস ফার্মা, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যালস, কোয়ালিটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোং, ইনোভা ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মা, ফার্মিক লি., সেইভ ফার্মা লি., বিকল্প ফার্মা, আলবিয়ন ল্যাবরেটরি, ইনট্রাফুড ইন্ড্রাট্রিজ লিমিটেডসহ বেশ কিছু কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ।রাজধানীর মিটফোর্ডের হাবিব মেডিকেলের ইস্রাফিল, দালাল তারেক, শরীফ মেডিসিনের মালিক রজ্জব শরীফ, মামুন ট্রেডার্সের অপু চন্দ্র ঘোষ, নায়না মেডিসিনের সবুর ও জসিম সার্জিকেলের আফজাল হোসেন যৌন উত্তেজক, শক্তিবর্ধক, ভিটামিন, ক্যান্সার প্রতিরোধক, গর্ভপাত ঘটানো, অজ্ঞান করার বিভিন্ন ইনজেকশন ও সিরাপসহ নানা নিম্নমানের ওষুধ আমদানি করেন এবং দেশি ওষুধে বিদেশি লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করে থাকেন।
এছাড়া নামিদামি কোম্পানির ওষুধ নকল করে কম দামে বাজারজাত করছে ওই ৬ ব্যবসায়ী চক্র। এতে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত ওষুধ কোম্পানি অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রোগীরা। নকল ওষুধের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসনের হলেও সেখানে কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে এ ব্যাপারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি সূত্রে জানা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক টেট্রাসাইক্লিনের কাঁচামালের সঙ্গে বরিক এসিড, গ্লিসারিনের সঙ্গে সরবিটল, রিবোফ্লোভিন, ভিটামিন বি-২ এর সঙ্গে ডাইকালার মিশিয়ে অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে টেট্রাসাইক্লিন, অক্সিটেট্রা সাইক্লিন, এমক্সিসিলিন, ডক্সিসাইক্লিন, মেট্রোনিডাজল, এমপিসিলিন, থিয়ামিন হাইড্রোক্সোরাইড পেনিসিলিন ও প্যারাসিটামল এবং বেশকিছু ওষুধ ও ইনজেকশনের কাঁচামাল।
অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
সূত্র জানায়, দেশে প্রায় সোয়া দুই লাখ ওষুধের দোকান আছে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬০হাজার দোকানের। অবশিষ্টগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই। ফলে তারা অবাধে নকল ওষুধ বিক্রি করছে। কেবল জনবল সংকটের কারণে এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা।
গোয়েন্দা সংস্থাটি তার প্রতিবেদনে ওষুধের নকল বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজদারি বাড়ানো, মাসে অন্তত তিন-চার বার ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা এবং নকল ও নিম্নমানের ওষুধ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।


আরও পড়ুন