এমপি বাহার শেষ পর্ব নিউজ

news paper

এইচ এম মহিউদ্দিন, স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২১-৮-২০২৪ বিকাল ৭:৪২

189Views

যে ভাবে কোটি টাকা আয় করতেন এমপি বাহার

     কুমিল্লা হাসপাতাল ও মেডিকেল জিম্মি
     এক রাতে ১৭৬৫ গায়েবি প্ল্যান পাস
     শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একক নিয়ন্ত্রণ
     শহরের ইন্টারনেট, ডিশ ব্যবসা:
     পরিত্যক্ত ভবন ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা

১৬ বছরের গুন্ডামী রাজত্ব করে কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহা উদ্দিন বাহার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব আয় তিনি নেতাকর্মীদের দিয়ে যে ভাবে আয় করতেন, শুধু আয় নয়, বিভিন্ন ভাবে হুমকি আর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের। যার ফলে তার প্রতিবাদ করতে পারেননি কুমিল্লার সুশিল সমাজ, সাংবাদিক ও ভোক্তভোগীরা। তার ধারাবাহিক পর্বের আজ শেষ পর্ব । কুমিল্লা হাসপাতাল, মেডিকেলও জিম্মি: ১০ বছর ধরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা সদর হাসপাতালে সব ধরনের কেনাকাটায় যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদের নজরদারিতে হতো। দরপত্র ছাড়া মালামাল কেনা, বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার্জিক্যাল রিকুইজিট কেনা, স্টাফদের খাবার সাপ্লাই, আউটসোটিংয়ের নিয়োগ বাণিজ্য, নির্মাণ কাজ, প্যাথলজি বিভাগে আদায় করা টাকা লোপাট, লিনেন ধৌতকরণ সবকিছু সহিদের হাত ধরেই হতো। অভিযোগ আছে তারা হাসপাতাল থেকেই মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করতেন। এই টাকা সহিদের হাত ধরে বাহারের কাছে চলে যেতো। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ কেনাকাটার আড়ালে সাবেক এমপি বাহার প্রায় ৬২০ কোটি টাকা নিয়েছেন। 

এক রাতে ১৭৬৫ গায়েবি প্ল্যান পাস:

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি একদিনে ১৭৬৫টি ভবন নির্মাণের প্ল্যান পাস করা হয়। ওই সময়ের কুসিক প্যানেল মেয়র বাহারের ভাতিজা হাবিবুল আলামিন সাদি এই প্ল্যান অনুমোদন দেন। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের আগে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এক রাতে এই বিপুল প্ল্যান অনুমোদন দেয়া হয়। জোর করে ইমারত কমিটিকে দিয়ে এই প্ল্যান পাস করে নেন বাহার। এর আগে স্বর্ণ কুঠির, এমআরসি সিলভার, জমজম টাওয়ারকে নকশা বহির্ভূত প্ল্যান অনুমোদন দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আছে বাহারের বিরুদ্ধে।

শহরের ইন্টারনেট, ডিশ ব্যবসা:

কুলিল্লা সিটি করপোরেশনের সিসিটিভি, ই-ট্রেড লাইসেন্স, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের আইটি সার্ভিস দেন সাবেক এমপি বাহারের মেয়ে আয়মান বাহার সোনালীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নাইস আইটি এন্ড পাওয়ার লি.। এ ছাড়া কুমিল্লা শহরের ডিশ ও ইন্টারনেটসেবা এককভাবে কার্নিভ্যাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার পতন হলেও এখনো তারাই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক এমপির জামাতা সাইফুল ইসলাম রনি।

বাহার পরিবারের যত গাড়ি:

এমপি বাহার, বড় মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা, মেজ মেয়ে আয়মান বাহার সোনালী, স্ত্রী নাসরিন বাহার প্রত্যেকে আলাদাভাবে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন। বাহার পরিবারের বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের অন্তত ৭টি গাড়ি আছে। প্রাডো, প্রিমিও, আরভি-৪, হ্যারিয়ার, ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৪৩০৮, ঢাকা মেট্রো গ-২৫-৯০৬৪, ঢাকা মেট্রো ১৭-১১৯২ গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একক নিয়ন্ত্রণ:

বাহার এমপি হওয়ার পরে প্রথমেই কুমিল্লার সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের দখলে নেন। স্কুল কলেজের কমিটিতে নিজের লোকদের বসান। কমিল্লা জেলা স্কুল, ফয়জুন্নেসা স্কুল, শৈলরানি দেবী হাইস্কুল, মডার্ন হাইস্কুলের ভর্তি বাণিজ্য বাহারের মেয়ে তানসিন বাহার সূচনা নিয়ন্ত্রণ করতেন। জানা গেছে, জিলা স্কুল ২০টি, ফয়জুন্নেছা ৩০টি সিট বাহার নিজেই দখলে রেখেছিলেন। প্রতি বছর এসব সিটের বিররীতে প্রায় ১০ লাখ টাকা সাবেক এমপির কাছে যেতো। গেল বছর কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় বদলি হওয়া ৩১ সহকারী শিক্ষক নতুন কর্মস্থলে যোগদানে বাধা দেন এমপি বাহার। পরে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে নিয়োগ পান তারা।

পরিত্যক্ত ভবন ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা:

কুমিল্লা শহরের সব পরিত্যক্ত সরকারি স্থাপনা দখলে রেখেছিলেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খোকন। তিনি বাহারের ডান হাত বলেই পরিচিত ছিলেন। কৃষি ব্যাংক, ফুলার হোস্টেল, লিবার্টি সিনেমা হল, কামিনী কুটির, অশোকতলার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মহিলা সংস্থার কার্যালয়, কান্দিরপাড় লাকসাম সড়কের বিএমএ ভবন, এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোম্পানির ভবন, ধর্মসাগরপাড়ের কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়, ঠাকুরপাড়ার মৃণালিনী দত্ত ছাত্রীনিবাস, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের ৩টি ভবন, বাগিচাগাঁওয়ের গণপূর্ত বিভাগের কোয়ার্টার, মনোহরপুরের জমি বন্ধকী ব্যাংক তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূণ এই স্থাপনা ভাড়া দিয়ে নিজেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরজমিন দেখা যায়, দীর্ঘ একযুগ আগেই রাজগঞ্জ এলাকার রাজবাড়ী কম্পাউন্ড-সংলগ্ন একটি দ্বিতল জরাজীর্ণ ভবনের নিচতলায় অন্তত ২০টি দোকানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই চিত্র নগরীর ব্যস্ততম কান্দিরপাড় এলাকার পূবালী ব্যাংক ভবনের নিচতলার। এ ভবনের উপরের ৩টি অংশে ‘স্থাপনাটি ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা থাকলেও অন্তত ১৫টি দোকানে ব্যবসা চলছে ঝুঁকি নিয়েই।

কেটিসিসিএ’র কোটি টাকা লুটপাট:

কোতোয়ালি থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন (কেটিসিসিএ)র বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটপাট হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪ একর জমির অধিকাংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লিজ ও ভাড়া দেয়া হয়েছে। কেটিসিসিএ’র পুকুর, ভবন, হলরুম ভাড়া দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়। পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন বাহারের ভাগিনা যুবলীগের আহ্বায়ক সহিদ ওরফ চিকে সহিদ। এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাহার তার ভাগিনা জুনায়েদ সিকদার অপুকে কেটিসিসিএ’র চেয়ারম্যান বানিয়ে রেখেছিলেন। নির্বাচন ছাড়াই তাকে জোরপূর্বক চেয়ারম্যান বানানো হয়। জানা গেছে, কেটিসিসিএ’র বছরে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আয় আছে। ধুলিপাড়া ফান টাউনের অপর পাশে কেটিসিসিএ’র জমি দখল করে বিল্ডিং নির্মাণ করেছেন বাহারের ভাগিনা। এ ছাড়া কুল্লিায়ার মদ খেয়ে পূজা মণ্ডপে আসলে পুলিশে দেয়া হবে মন্তব্য করে দেশব্যপী সমালোচিত হন সাবেক এমপি বাহার। পরে এই নিয়ে হিন্দুরে মধ্যে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারত থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। এ ছাড়া পাহাড় কাটায় প্রতিবাদ করার পরিবেশ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালকে ১৫ দিনের মধ্যে কুমিল্লা ছাড়ার নির্দেশ ও অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আলোচিত হন সাবেক এই এমপি। জানতে চাওয়া হলে সাবেক সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, বাহার বেপরোয়া ছিলেন। কিছুই কেয়ার করতেন না। নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান মনে করতেন। সে কুমিল্লা শহরে এমন একটি ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে উনি যা করবেন সেটাই সঠিক ছিল। কেউ তার বিরুদ্ধে যেতে চাননি। শহরের সব চাঁদাবাজি, দখলবাজি তার লোকেরাই করতেন। তার ভাতিজা, জামাই ও মেয়েরা এসব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কুমিল্লা শহরে তার অনিয়নম অবিচারের বিরুদ্ধে একমাত্র আমিই সোচ্চার ছিলাম।অভিযোগের বিষয়ে এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের বক্তব্য জানতে তাকে ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।


আরও পড়ুন