বিলুপ্ত হয়ে গেছে পল্লী গাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরি মাচা

news paper

বারহাট্টা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪-৫-২০২৫ দুপুর ২:৪৯

69Views

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে গেছে আহবমান গ্রাম-বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য 'বাঁশের তৈরি মাচা'। কালের বিবর্তনে ও আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে গ্রামে-গঞ্জে এখন আর চোখে পড়ে না গাছের ছায়ায় খোলা মেলা পরিবেশে বাঁশের তৈরি মাাচা।

'কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান, বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিদ্যমান। ভুলেও মাটির পানে তাকায়না তাই, চন্দ্র সূর্য তারকারে করে 'ভাই ভাই'।' কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কণিকা' কাব্য গ্রন্থের 'যথার্থ আপন' কবিতায় আবহমান গ্রাম বাংলার গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্য বাঁশের তৈরি মাচা একসময়ে ছিল পল্লী গাঁয়ের আসল সৌন্দর্য।

একসময় দেখা যেতো, পল্লী গাঁয়ের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় গাছ তলায় ফাঁকা জায়গায় বাঁশের তৈরি মাচা। গরম আসলেই সেখানে রৌদ্রজ্জ্বল দুপুর কিংবা রাতে সকল বয়সের ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলের আড্ডার স্থান ছিল এই মাচা। কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত গ্রামীণ ঐতিহ্য বাঁশের তৈরি মাচা।

সরেজমিনে উপজেলা সদরের গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা গ্রাম ঘুরে ও বয়ষ্কদের সাথে কথা বললে তারা সকালের সময়কে জানান, এমন একসময় ছিল যখন গ্রামের মানুষ সারাদিন কৃষি কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পরন্ত বিকেলে ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়ায় মাচার উপর বসে সবাই মিলে খোশগল্পে মেতে উঠতো। যুগ যুগ ধরে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এই মাচা ব্যবহার করা হতো।

উপজেলা সদরের যশমাধব গ্রামের কুতুব উদ্দিন (৭০), আনসার আলী (৬৫), সাহতা ইউনিয়নের মহব্বত হাওলাদার (৬৫), রমেশ তালুকদার (৭৫) সহ বিভিন্ন এলাকার প্রবীণদের সাথে কথা বললে তারা জানান, আগে পল্লী গাঁয়ের মানুষ আমরা যারা ফসলের মাঠে যারা কাজ করতাম, কাজের ফাঁকে গাছ তলায় তৈরি মাচার উপর বসে একটু বিশ্রাম নিতাম। মাচার উপরে যেহেতু গাছ ছিল তাই এর ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা হাওয়ায় মন ও শরীরে প্রশান্তি এনে দিতো। আড্ডার প্রধান উপকরণ ছিল হুক্কা। হুক্কা টানার গড় গড় শব্দে মেতে উঠতো চারদিক। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফসলের মাঠে কাজে নেমে যেতাম। তাছাড়া নানা রকম খোশগল্প হতো গাছের নিচে মাচার উপর বসে।

তারা আরও জানান, এক সময় এই গাছের নিচে বসে নানা ধরনের সরস আড্ডা হতো। গাঁয়ের কারও ছেলে অথবা মেয়ের বিয়ের বয়স হলেও এখনো বিয়ে হচ্ছে না, কে কার সঙ্গে লাইন (প্রেম-ভালোবাসা) করছে, কার সঙ্গে কার জমি নিয়ে বিরোধ, কে বাবা-মাকে ভাত দেয় না-এ রকম নানা আলোচনা-সমালোচনা হতো এই আড্ডা থেকে।

কথা হয় বাউসী ইউনিয়নের মোয়াটি গ্রামের জজ মিয়ার সাথে তিনি বলেন, এখনও আমাদের গ্রামের কিছু কিছু বাড়িতে মাচা আছে। মানুষ এই মাচার উপর বসে আড্ডা দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যখন বিদ্যুৎ না থাকে, তখন রাতভর আড্ডা চলে মাঁচার উপর। এই মাঁচার উপর বসেই এলাকার সকল খবরা খবর পাওয়া যায়। এটা এমন একটা বৈঠকখানা যে বৈঠকখানায় ভালো মন্দ সমস্ত আলাপ-আলোচনা হয়। এলাকার বয়স্ক মানুষ এই মাঁচায় শুয়েও থাকে। সকল ক্লান্তি দূর করার জন্য মাচা একটি উত্তম স্থান। কিন্তু দিনে দিনে মাচার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো আড্ডাও হয় না।

মাচা তৈরির কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাচা মূলত বাঁশ দিয়ে তৈরি। বাঁশ কাটার পর কিছু দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সেখান থেকে তুলে, ফালি করা হয়। সেই ফালি রৌদ্রে শুকিয়ে চারদিকে খুঁটি মেরে মাচা তৈরি করা হয়। গ্রামের বাঁশবাগান, আম গাছের তলায় বা কোনো বড় গাছের শীতল ছায়ায় বাঁশ দিয়ে মাটি থেকে ২-৩ ফুট উঁচু করে তৈরি করা হয় এই মাচা। এসব মাচায় ৭ থেকে ৮ জন মানুষ বসতে পারে।

বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল ও কলেজ) সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমেন বিশ্বাস বলেন, আমাদের গ্রামে এখনো এমন আড্ডা দেওয়ার জায়গা রয়েছে। এক সময় বাঁশের চটা দিয়ে মাচা তৈরি করা হলেও এখন বাঁশের তৈরি মাচা দেখা যায় কম। অধিকাংশ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা ইট দিয়ে উঁচু করে সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে তৈরি করে ইটের মাচা। এসব জায়গায় গরমের দিনে বসে গল্প গুজব আর আড্ডায় মেতে উঠেন প্রবীণ ব্যক্তিরা। প্রবীণ ব্যক্তিদের মুখে শৈশবের নানা গল্প আর স্মৃতিচারণে জমে উঠে এসব মাচা। এমনকি গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং বিচার সালিশও করা হয় এসব মাচায় বসেই। তবে যুগের পরিবর্তনের ধারায় আধুনিক যুগে মাচায় বসে গল্প করার সেই ঐতিহ্য প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্রামের মানুষেরা আড্ডা দেয় বাজারের চায়ের দোকান বা কোনো মুদির দোকানে এবং সেখানে টেলিভিশনই প্রধান আকর্ষণ। চায়ের আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা, খবর, টকশো’ নানা অনুষ্ঠান দেখতে তারা পছন্দ করেন। তাছাড়া গ্রামের মানুষের এখন কাজের ধরনও পাল্টে গেছে। চাষিরা সারা বছরই কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মাঠে, কৃষি জমিতে। তাছাড়া প্রচন্ড গরমের কারণে বেশির ভাগ কৃষকই কাজ ভোর থেকে শুরু করে মাঠের কাজ সেরে নেন বেলা ১০ থেকে ১২ টার  মধ্যে। এরপর তারা গ্রামের মোড়ে কিংবা রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় আড্ডাতে মেতে ওঠেন। বড় গাছের ছায়ায় বসলে দক্ষিণা বাতাসে তাদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

বারহাট্টা উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কালেরকন্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির আঙিনায় মাচা ছিল।  এখনও গ্রামের পথে হাঁটতে গেলে কোথাও মাচা দেখলে, মাচায় বসে আড্ডা দেই , তখন মনে ভেসে ওঠে শৈশবের স্মৃতি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে মাচা ছিলো। যেখানে বসে সবাই আড্ডা দিতাম। অনেকদিন গ্রামে যাওয়া হয় না, তাই মাচাতেও বসা হয় না। মাচায় বসে আড্ডা দিতে আমার বেশ ভালো লাগে।

তিনি আরও বলেন, একসময়ে জ্যোৎস্না রাতে এই মাচার উপরে বসে রাত্রিবেলা চাঁদের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যেতো। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা হাওয়ায় শীতল হয়ে যেতো মন প্রাণ। মাঝে মাঝে মনে হয়, আবার যদি ফিরে যাওয়া যেতো শৈশবে।


আরও পড়ুন