নেপলস অথবা বুয়েন্স আয়ার্স- ম্যারাডোনা কি সত্যিই নেই?

news paper

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৫-১১-২০২১ দুপুর ৩:৫৮

7Views

হাত দুটো তার বুকে তখন। দুই হাত বুকে জড়িয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন। চোখেমুখে তার স্পষ্ট ছাপ। কী করবেন যেন বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিকঠাক। চিৎকার করে বুঝাতে চাইছেন, পৃথিবীটা জয় করে ফেলেছেন তিনি। তখন কেবল একটি গোলই হয়েছে। ম্যারাডোনা আসলে করতে পারেননি কিছুই! নাহ, এত বড় ধৃষ্টতা না দেখাই। আসলে তার দেশ আর্জেন্টিনা পারেনি, অন্তত তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন!

কী আশ্চর্য, ম্যারাডোনা চলে যাওয়ার পরের সালটাতেই কি না তারা পারল! ১৪ জুলাই, ২০২১; ২৮ বছর পর আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতার পর- ম্যারাডোনা কি করতেন? দুই হাত ছড়িয়ে দিতেন আকাশে? কাঁদতে শুরু করতেন? আবেগে থর থর হয়ে যেতেন? নাকি অন্য কাউকে এক হাত নিয়ে নিতেন, যারা তার দেশটাকে 'হার্জেন্টিনা' বলে ডাকত?

ম্যারাডোনা কী বলতেন বুঝা মুশকিল। আর এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই বোধ হয় ম্যারাডোনা মাঠে কী করবেন সেটা বুঝতে পারা। যে ম্যাচে তিনি হাত দিয়ে গোল করে নিজেই তার নাম দেন 'হ্যান্ড অব গড' আবার ওই ম্যাচেই তিনি করে ফেলেন 'গোল অব দ্য সেঞ্চুরি'। কী অদ্ভুত ব্যাপার।

ম্যারাডোনা কী পেরেছেন তার চেয়ে তো বড় প্রশ্ন হওয়ার কথা কী পারেননি। বিশ্বকাপ জিতেছেন, নাপোলিকে ইতালির সেরা করেছেন, ডোপ নিয়ে করেছেন স্বপ্নভঙ্গও। স্বপ্ন যিনি দেখাতে বা পূরণ করতে পারেন; তিনি কীভাবে আবার সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন হয়েছেন তার উদাহরণ। বা পায়ে তিনি হাজারো 'কবিতা' লিখেছেন সিদ্ধহস্ত কবির মতোই। কবিতাই তো! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে বুয়েন্স আয়ার্সের কাউকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন, ফুটবল পায়ে কীভাবে কবিতে লেখা যায়! 

নেপলসে অবশ্য এসব জিজ্ঞেস করতে গেলেও বিপদে পড়তে পারেন। সেখানে তিনি শিল্পী বা ফুটবলারের চেয়েও বেশি কিছু। নেপলসের মতো নিপীড়িত শহরে, ম্যারাডোনা 'ঈশ্বর'। ঘরে ঘরে ম্যারাডোনার ছবি রাখা হয়, পূজাও করা হয় নিয়মিত। আজই যেমন, ম্যারাডোনার মারা যাওয়ার ঠিক এক বছরের দিনে- নেপলসে দুটি মূর্তি রাখা হয়েছে। 

দেয়ালে দেয়ালে ম্যারাডোনার ছবি এঁকে দেওয়া। মুখে মুখে সেখানে আজ কেবলই আর্জেন্টাইন জাদুকর। বুইন্স আয়ার্সে? যেখানে তিনি বেড়ে উঠলেন তারাও ভুলতে পারেননি একটি মুহূর্তের জন্যও। টিভিতে, দেয়ালজুড়ে, মানুষের মুখে মুখে। ম্যারাডোনা আসলে কোথায় নেই? এই যে, নির্মম প্রশ্নটা চলেই এলো!

ম্যারাডোনা তো পৃথিবীতে নেই। সত্যিই? লিওনেল মেসি তো বিশ্বাস করতে পারেন না আজও। জাদুকররা কি মারা যায়? তাহলে কেন আর্জেন্টিনার শিরোপা জেতার পর বারবার করে কেবল ম্যারাডোনার কথাই মনে পড়বে। জানতে ইচ্ছে করবে ম্যারাডোনা কী করতেন এখানে থাকলে। অথবা যেদিন বলিভিয়ার বিপক্ষে মেসির হ্যাটট্রিকের পর দেশের মানুষের সামনে কোপার ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরলেন, মেসি কাঁদলেন। সেদিন?

ম্যারাডোনা যদি নাই থাকবেন, তাহলে নেপলস শহরে কুঁকড়ানো চুলের সুবিস্তৃত হাসিমুখের এক মানুষের ছবিতে ভরে উঠে কেন। মানুষ অবশ্য তিনি কেবলই রক্ত-মাংসের বলে। বুইন্স আয়ার্সের যে জেদি ছেলেটা আট ভাই-বোনের অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠল। 

একটা ফুটবলের বায়না ধরে মাকে ওই ছেলেটা জ্বালিয়ে মারতো। বলটা পাওয়ার পর, রাতেও বুকে বলটাকে আগলে রেখে ঘুমাতো যে ছেলেটি। সে-ই পড়ে এই ফুটবলের রাজা হয়ে উঠলেন। হয়ে গেলেন নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি।

যুদ্ধের বদলা নিতে হাত দিয়ে গোল করলেন। পা দিয়ে জাদু দেখালেন। করলেন তো আরও কত কিছুই। বেঁচে থাকতেই হয়ে উঠলেন রূপকথা। বুইন্স আয়ার্সের মায়েরা তার গল্প শোনাতে শুরু করলেন। ছেলেদের নিশ্চয়ই মনে হওয়ার কথা সেসব অবাস্তব। নেপলসের বাবারা বললেন, খবরদার ম্যারাডোনা ছাড়া আর কারো ভক্ত হওয়া যাবে না কিন্তু।

ছেলেদের নিশ্চয়ই বিরক্ত লাগতো সেসবও। কিন্তু কিইবা করার ছিল তাদের! ম্যারাডোনাকে যে বিশ্বাস করতেই হতো। মদ আর নারীতে মজেছিলেন পরে-তখনও। ফিফাকে এক হাতে নিয়েছেন, বাজে বকেছেন; তবুও তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কার ছিল!

মনে যা আসতো-তাই বলতেন। মানুষের তো এমনই হতে হতো। কিন্তু ম্যারাডোনা কি বড্ড তাড়াতাড়িই চলে গেলেন না? তা না হয় গেলেন। কিন্তু কেবল মাত্র একটি খেলায়, একটা ফুটবল পায়ের কারুকার্যে- নেপলসে, বুয়েন্স আয়ার্সে, আর্জেন্টিনায় অথবা সহস্র কিলোমিটার দূরের এই বাংলাদেশে। তার মতো ছড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন আর কে?

ম্যারাডোনা তাই মরেও বেঁচে আছেন। এক বছর পর। হাজার বছর শেষেও থাকবেন। অন্তত আর্জেন্টিনার শিরোপা জেতায়। নাপোলির উত্থানে অথবা নেপলসের পুরো শহরটিতেই। ম্যারাডোনা, আপনি কিন্তু এখনও আছেন। কিন্তু তবুও আর কটা দিন কেন থাকলেন না?


আরও পড়ুন