সঙ্কটে ধুঁকছে রেল
প্রকাশিত: ১২-১২-২০২২ দুপুর ১২:৪
ট্রেনে হকার, হিজড়া ও ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ যাত্রীরা
স্টেশনের জায়গা দখল করে দোকানপাট-ঘরবাড়ি নির্মাণ
মূল্যবান সম্পদ অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে বহুকাল ধরে
দখল-দূষণসহ নানা সঙ্কটে ধুঁকছে বাংলাদেশ রেলপথ। সঙ্কট উত্তরণে কোনো প্রচেষ্টাই যেনো কাজে লাগছে না এ মন্ত্রণালয়ে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নানা প্রকল্পের মধ্যেও লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দপ্তরটি। তাছাড়া তেল থেকে শুরু করে রেলের সিগন্যাল মোটর চুরি বরাবরই অস্থিরতার মধ্যে রেখেছে দপ্তরটির দায়িত্বশীলদের। বিশেষ করে রেলপথের স্টেশনগুলো এক সময় যাত্রীর উপস্থিতিতে থাকতো সরগরম। কিন্তু সেবার মান ও বেশ কিছু ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রী সংখ্যা কমেছে ব্যাপক হারে। যাত্রীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। রেলপথ উন্নয়ন করা হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত বসার স্থান নেই, নেই পাবলিক টয়লেট। এছাড়া ট্রেনে হকার, হিজড়া ও ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ যাত্রীরা। অনেকবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পাননি যাত্রীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে রেলের সম্পত্তি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানপাট। আবার অনেকে ঘর তুলে বসবাসও করছেন। এছাড়া যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নষ্ট হচ্ছে স্টেশনের পরিবেশ। বিভিন্ন সূত্র জানায়, এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিত্তবানরা স্টেশনের জায়গা দখল করে দোকানপাট-ঘরবাড়ি গড়ে তুলেছেন। আবার অনেকে সরাসরি না গিয়ে অন্যের মাধ্যমে দখল করছে সরকারি সম্পত্তি।
রেল অধিদপ্তর ডিজির বরাবর দায়ের করা এক অভিযোগের কপি থেকে জানা গেছে, যশোর অঞ্চলে রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার মূল্যবান সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চোখের সামনে। উপরন্তু রেলওয়ের জমি বেদখল এবং সম্পদ চুরি ও নষ্টের ঘটনা বেড়েছে। তারপরেও কর্মকর্তাদের টনক নড়ছে না। স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, শুধু লোহারপাত নয়, ওয়াগন ও বগি এমনকি রেলওয়ের জমিজমাও রক্ষায় যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না। রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন- যশোর, নওয়াপাড়া, কালীগঞ্জসহ যশোর অঞ্চলের ছোট-বড় স্টেশন ও জংসনে সরকারের মূল্যবান সম্পদ অব্যবহৃত, অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে বহুকাল ধরে। ওয়াগন, বগী, লোহার পাত, ইস্পাত, সিøপার ও লোহালক্কড় খোলা আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টিতে বছরের পর বছর পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। চুরির ঘটনাও কম নয়। প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হলেও এ ব্যাপারে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দৃষ্টি দেয় না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। রেলওয়ের পরিত্যক্ত স্টেশন এবং গুদামের জানালা দরজা ও টিন খুলে নেয়ার ঘটনা অসংখ্য। পরিত্যক্ত স্টেশনে একজন পাহারাদার থাকে নামকাওয়াস্তে। তারা সরকারি সম্পত্তি তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লুটেরাদের বিরুদ্ধে কখনোই মুখ খোলে না সহসা।
শুধু যশোর অঞ্চলে নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় রেলপথে যাতায়াত করলে স্পষ্ট দেখা যাবে ট্রেন লাইনের প্রায় গা ঘেঁষে অনেক জমি দখল হয়ে গেছে। বাড়িঘর নির্মাণ, চাষাবাদ ও গাছ-গাছালি লাগিয়েছে আশপাশের লোকজন। যশোর রেলওয়ে স্টেশনের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বস্তি ও দোকানপাট। ট্রেন লাইনের দু’ধারে নির্দিষ্ট এলাকার ফাঁকা জায়গা থাকে। যা অনেকটা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। যশোরের শিল্পশহর নওয়াপাড়ার কমার্শিয়াল এলাকার কিছু জমি ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দখল করে নেয়ার ঘটনায় আদালতে মামলা হয় কয়েক বছর আগে। স্টেট অফিসার দখলকারীদের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে অনুপস্থিত থাকায় একতরফা রায় হয় দখলকারীদের পক্ষে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যশোর-বেনাপোলের ঝিকরগাছা, নাভারণ, অমৃতবাজার, যশোর-খুলনা রেলপথের সিঙ্গিয়া, চেঙ্গুটিয়া, যশোর-চুয়াডাঙ্গা রেলপথের মেহেরুল-নগরসহ অনেক রেলওয়ে স্টেশন পরিত্যক্ত হয়ে গেছে বহু আগে। ওইসব স্টেশনের আসবাবপত্র, সিগন্যাল যন্ত্রপাতি ও জিনিসপত্র লোপাট হয়েছে। পড়ে থাকা অনেক স্টেশনের ঘরের ছাদ ভেঙে লোহার এঙ্গেল লোপাটের ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে মূল্যবান যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে। এমনকি মাটির সাথে মিশে গেছে বহু সম্পদ। রেলসম্পদ রক্ষার্থে কখনোই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় না। স্থানীয়ভাবে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করলেও সরকারি মূল্যবান জমি ও সম্পদ রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে দেখাশুনা করার দায়িত্ব যাদের তারা বরাবরই হেলাফেলা করে। কেউ রেলওয়ের সম্পত্তি দখল করলে আবার ঝামেলা এড়াতে প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না এমন অভিযোগও আছে। সবার চোখের সামনে রেলসম্পদ নষ্ট হচ্ছে কিংবা লোপাট হচ্ছে অথচ আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত থাকছে। রেলওয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের এমন অভিযোগও আছে সম্পত্তি সরকারের অথচ দেখভাল করার নামে দখলকারীদের সাথে যোগসাজসে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বেহাত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্র যেমন নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়, তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব দেশের বা রাষ্ট্রের সম্পদের সুরক্ষা করা। কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করা যাবে না। দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টকারীদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অনিষ্ট বা ক্ষতি করলে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। এমন কথা দণ্ডবিধিতে উল্লেখ থাকলেও কর্তৃপক্ষ এগুলো আমলে নিতে যেনো একেবারেই উদাসীন। এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে একাধিকবার অবহিত করা হলেও তিনি যেনো অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। এমনকি গণমাধ্যমে কথা বলতে তিনি কোনো আগ্রহ দেখাতেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেলপথটি ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে প্রায় ২৮ কিলোমিটার রেলপথ। নজরদারির অভাবে চুরি গেছে অধিকাংশ রেল। অবশিষ্ট যেটুকু আছে, তা-ও চাপা পড়েছে মাটির নিচে। রেলপথটিতে ব্যবহৃত মূল্যবান নাটবল্টু তার, সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ স্টেশনের আনুষঙ্গিক অবকাঠামোর বেশির ভাগই আর নেই। শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ সেকশনের প্রায় ১৪ কিলোমিটার রেলপথের অবস্থা আরো খারাপ। ২০০৩ সাল থেকে বন্ধ রেলপথটির কোনো মালামালই এখন আর বহাল তবিয়তে নেই। কিছু রেল তুলে রাখা হয়েছে শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে। অন্যদিকে রশিদপুর সাইডিং লাইনে রেল থাকলেও ফিশ প্লেট, ফিশ বোল্ট, স্লিপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মালামালের কোনো অস্তিত্ব নেই।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের দুই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত রেলপথ পূর্বাঞ্চলে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ২০ কিলোমিটার, ময়মনসিংহে ১২ কিলোমিটার, জামালপুরে ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার ও গাজীপুরে দশমিক ৫ কিলোমিটার রেলপথের অবস্থান এখন মাটির নিচে। এসব পথে কোনো স্লিপার নেই। নেত্রকোণা জেলায় থাকা পরিত্যক্ত রেলপথের পরিমাণ ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এ পথে রেল ও কিছু অকেজো স্লিপার এখনো রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। কিশোরগঞ্জ জেলায় থাকা ১ কিলোমিটার পরিত্যক্ত রেলপথের মধ্যে ৪০০ ফুট অংশে নবায়নকাজ চলছে। এ অংশটি ইঞ্জিন সান্টিংয়ের (ঘোরানো) জন্য ব্যবহার করা হবে। বাকি অংশে কোনো রেল, ফিশ প্লেট, ফিশ বোল্ট ও স্লিপার নেই। অন্যদিকে নরসিংদীতে পরিত্যক্ত রেলপথ আছে ২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। যদিও সে পথের কোনো অবকাঠামোর অস্তিত্ব নেই।
কমিউটার, গুডস সাইডিং ও এলএসডি মালগুদাম সাইডিংয়ের ৩ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার রেলপথ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় বর্তমানে মাত্র ২০ শতাংশ স্লিপারের ওপর রেলপথের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। রেল বাদে এ লাইনে আনুষঙ্গিক কোনো ফিটিংস নেই। অন্যদিকে সাইডিং লাইন ৭, ৮ ও ৯-এর ৮০ শতাংশ কাঠের স্লিপার অকেজো ও পচে নষ্ট হওয়ায় শুধু রেল লাইন পড়ে আছে। মৌলভীবাজার জেলায় থাকা পরিত্যক্ত রেলপথের পরিমাণ ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে সাতগাঁও সাইডিং লাইনের রেলের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ফিশ প্লেট, ফিশ বোল্ট, স্লিপারের মতো মালামাল খুঁজে পাননি রেলওয়ের কর্মচারীরা। একই অবস্থায় রয়েছে শ্রীমঙ্গল ও ভানুগাছ সাইডিং লাইন।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত রেলপথ হবিগঞ্জ জেলায়। এরপর সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক ২ কিলোমিটার পরিত্যক্ত রেলপথ রয়েছে ফেনীতে। ফেনী-বিলোনিয়া সেকশনে থাকা এসব রেলপথের কিছু চলে গিয়েছে মাটির নিচে, কিছু অংশ এখনো মাটির ওপরে আছে। তবে আনুষঙ্গিক বেশির ভাগ মালামালের কোনো খোঁজ নেই। হারানো মালামালের জন্য থানায় এজাহার দায়ের করে রেখেছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম জেলায় পরিত্যক্ত রেলপথ আছে ১০ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে টিএসপি সাইডিং লাইনটি রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়, হারিয়ে গেছে সব স্লিপার। একই অবস্থা স্টিল মিলস সাইডিং লাইনেরও। আর জেটি ইয়ার্ডের ৭০ শতাংশ রেলের কোনো অস্তিত্ব নেই।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে সব মিলিয়ে পরিত্যক্ত রেলপথ আছে ৩০ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাবনায় ভাঙ্গুরা সাইডিং লাইনের ৮৬৫ মিটার, নওগাঁ জেলার আত্রাই ঘাট লাইন ১, ২ ও ৩-এর ৬৬৮ মিটার ডাবল হেড রেল রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত রেলপথ আছে গাইবান্ধা জেলায়, ১৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ত্রিমোহনী-বালাসীঘাটের ৯ কিলোমিটার ও বোনারপাড়া-ভরতখালীর ৮ কিলোমিটার রেললাইন ও ফিটিংস পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। একইভাবে ১২ কিলোমিটার পরিত্যক্ত রেলপথ আছে লালমনিরহাট জেলায়।
এতসব সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে হলে আগে রেলের কালো বিড়ালদের তাড়াতে হবে বলে মনে করছেন রেলে সৎ কর্মকর্তারা। তারা মনে করছেন, নিজেদের আখের গুছাতে কিছু অসৎ রেল কর্মকর্তারা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে রেলকে নিয়ে যাচ্ছে লোকসানের দিকে। অনিয়ম দুর্নীতির বিচার না করা ও তদন্ত রিপোর্ট তালাবন্ধ করে রাখাও রেলের একটি বড় সঙ্কট বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে সম্প্রতি সময়ে তদন্ত হওয়া প্রতিটি বিষয়ের ফাইল ওপেন করে প্রচলিত আইনমোতাবেক বিচার করা হলে বিদ্যমান কিছু সঙ্কট থেকে অন্তত রেল রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।