জীবন যায় সাধারণ মানুষের

ম্যানেজে চলে অবৈধ নৌযান

news paper

এম. শাহজাহান

প্রকাশিত: ২১-১২-২০২২ দুপুর ১:১৬

16Views

দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই মানুষ আহত, নিহত ও নিখোঁজ হচ্ছেন। প্রতিবছর নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে চললেও নৌ-দুর্ঘটনা রোধে এখন পর্যন্ত তেমন একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট অনেককেই ম্যানেজ করে নদীতে চলছে ছোট-বড় অবৈধ নৌ-যান। আর এসব অবৈধ নৌ-যান দুর্ঘটনায় অকালে জীবন হারাচ্ছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, নৌ-পথে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর না করা, নৌ-যান চালকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন নৌ-যান চলাচল করার সুযোগ পাওয়াসহ বিভিন্ন নৌ-যানে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই হচ্ছে এসব নৌ-দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

বিশেষ করে অবৈধ উপায়ে রুট পারমিট নিয়ে নৌ-পথে চলাচলকারি নৌ-যানগুলোই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ পর্যন্ত যে গুলো নৌ-যান দুর্ঘটনায় পড়েছে তার প্রত্যেকটির তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে ওই নৌ-যানগুলো রুট পারমিট বা ফিটনেস সনদ ছিল না অথবা অতিরিক্ত যাত্রী বহনে এই দুর্ঘটনায় পড়েছিল নৌ-যানটি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ১০ হাজারের বেশি স্পিডবোট চলাচল করছে বিভিন্ন নদীতে। এসব স্পিডবোটের অধিকাংশগুলোরই নেই রুট পারমিট। বিশেষ করে এই স্পিডবোটগুলো বিশেষ নক্সা পাশ করিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র নিয়ম মোতাবেক তৈরি হবে। তারপর করতে হবে সার্ভে। সার্ভে রিপোর্ট হাতে পেয়ে নৌ-নিট্রা দেবে রুট পারমিট। কিন্তু স্পিডবোটের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব নিয়মের কথা তারা জানেনই না। আর নদীগুলোতে তারা এই স্পিডবোটগুলো চালাচ্ছেন তাদের ইচ্ছেমতো। এর ফলে ঘটছে নানান দুর্ঘটনা। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছোটবড় প্রায় হাজারখানেক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর প্রাণ গেছে প্রায় আড়াই হাজার। কতজন নিখোঁজ হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। আহত হয়েছেন অনেকে। দেশে বর্তমানে যেসব নৌপথ রয়েছে, তার বেশির ভাগই অরক্ষিত। 

বিআইডব্লিউটিএ’র এক সূত্রে জানা গেছে, এসব নৌপথে বৈধভাবে প্রায় ৩ হাজার ছোটবড় লঞ্চ, জাহাজ চললেও স্পিডবোটসহ অনুমোদনহীনভাবে চলছে কয়েক গুণ নৌযান। তাছাড়া নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যতসংখ্যক নৌ-পুলিশ থাকা প্রয়োজন, তা নেই। এসব নৌ-পুলিশকে বিআইডব্লিউটিএ’র কিছু সার্ভে জাহাজ ও স্পিডবোট দেওয়া হলেও এসব নৌ-যানে নৌপথের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন আধুনিক যান। অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা আটক বা গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত টাকার জোরে বা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অথবা নানা কৌশলে ছাড় পেয়ে যায়। 

সূত্রে আরও জানা গেছে, নৌ-দুর্ঘটনার জন্য দায়ী স্পিডবোট মালিক বা লঞ্চ মালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে। বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের বিষয়ে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে। তাছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউই শেষ পর্যন্ত শাস্তি পায় না।

বিআইডব্লিউটিএ’র বিশেষ এক অভিযানে ঢাকা (সদরঘাট) থেকে দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী অন্তত ১২টি বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ইঞ্জিনগত ত্রুটি। ওই লঞ্চের ইঞ্জিনের বডির ওপর ব্র্যান্ড, হর্সপাওয়ার (শক্তি), নির্মাণ সাল কিছুই উল্লেখ নেই। পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হচ্ছে এসব লঞ্চ। অথচ সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সনদে ভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনের নাম ও মডেল উল্লেখ রয়েছে। গত ডিসেম্বরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ভয়াবহ আগুনে প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চেও পুরোনো ইঞ্জিন ছিল। এছাড়া মাওয়ার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী-মাঝিকান্দি রুটে চলাচলকারী ৮৪টি লঞ্চের সবকটিতে কমবেশি নিরাপত্তা ত্রুটি পাওয়া গেছে। এসব লঞ্চের মধ্যে কয়েকটির ভারসাম্যগত ভয়াবহ ঝুঁকিও রয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নিজস্ব একাধিক প্রতিবেদনে এসব ত্রুটি উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, গত নয় বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর ৩৯টি দুর্ঘটনায় ১৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন ১৭৯ জন। এর আগে ২০১২ সালে ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৬৩ জন মারা যান।

এ বিষয়ে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা আইন ও বিধিগুলো যুগোপযোগী করছি। চালকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো হচ্ছে। তারপরও অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে রয়েছে। আইন মানা, রুট অনুযায়ী নৌযান চলাচল করার মতো চ্যালেঞ্জ নিয়মিত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এছাড়া মালিক ও যাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর বড় বড় লঞ্চগুলোর অবস্থা পরিদর্শনে পাঁচটি কমিটি গঠন করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই কমিটিগুলোর মাত্র ১৫-১৮টি লঞ্চ পরিদর্শনের পর বাধার মুখে ওই কার্যক্রম এগোয়নি। ওইসব কমিটির প্রতিবেদনে অন্তত ১২টি লঞ্চে পুরোনো ও নেমপ্লেটবিহীন ইঞ্জিন ব্যবহারের তথ্য উল্লেখ করা হয়। লঞ্চগুলো হচ্ছে-মিতালী-৭, স্বর্ণদ্বীপ-৮, মিরাজ-৬, নিউসান, টিপু-৪, রাজহংস-৮, পারাবত-১৮, আল-ওয়ালিদ-৯, কর্ণফুলী-৩, ফারহান-৪, পারাবত-১৫ ও গ্লোরী-অব-শ্রীনগর-৩।

পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা-বরিশাল রুটের পারাবত-১৮ লঞ্চের সার্ভে সনদে ওই লঞ্চে জাপানের আকাসাকা কোম্পানির ৭০০ হর্সপাওয়ার শক্তিসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিনের কথা উল্লেখ রয়েছে। বাস্তবে যে ইঞ্জিন রয়েছে সেটিতে কোনো নেমপ্লেট না থাকায় কোম্পানি, মডেল ও হর্সপাওয়ার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। যে ইঞ্জিন দুটি রয়েছে তা অনেক পুরোনো বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ঢাকা-চাঁদপুর রুটের মিতালী-৭ লঞ্চের সার্ভে সনদে যে ইঞ্জিন থাকার কথা সেটি ছিল না। সেখানে দুটি পুরোনো ইঞ্জিন পেয়েছে কমিটি। ঢাকা-হাটুরিয়া রুটের এমভি স্বর্ণদ্বীপ-৮ লঞ্চের ইঞ্জিনেও কোনো নেমপ্লেট পায়নি কমিটি। এর ফলে ওই ইঞ্জিনের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারেনি কমিটি।

এদিকে পিনাক-৬সহ একাধিক লঞ্চডুবির তদন্ত প্রতিবেদনে সানকেন (নিমজ্জিত) ডেকবিশিষ্ট লঞ্চ বন্ধের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশ উপেক্ষা করে বাস্তবে সারা দেশে দুই শতাধিক সানকেন ডেক বিশিষ্ট লঞ্চ চলাচল করছে। এর মধ্যে মাওয়ায় প্রায় ৮০টি, আরিচায় ৩৪টি, নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৭০টি, ভৈরব এলাকায় ৪০টির বেশি এ ধরনের লঞ্চ চলে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় নৌদুর্ঘটনার পর ওই জেলা থেকে সব ধরনের সানকেন ডেকবিশিষ্ট লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধের আদেশেও এসব লঞ্চে যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে বলে উল্লেখ করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সানকেন ডেকবিশিষ্ট লঞ্চ অল্প আঘাত পেলেই বা বৈরী আবহাওয়া হলেই ডুবে যায়। পিনাক-৬, সাবিত আল হাসান ও এমএল আফসার উদ্দিন এর বড় উদাহরণ। তারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রণালয়ের এক আদেশের সুযোগে ৫০ বছরের পুরোনো সানকেন ডেকবিশিষ্ট ছোট লঞ্চ এখনো চলাচল করছে। যদিও আইনে একটি নৌযানের আয়ুষ্কাল ৪০ বছর। কিন্তু তারপরও কোনো কর্মকর্তাদের স্বার্থে মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চলছে সানকেন তার কারণ জানতে চান সংশ্লিষ্ট অনেকেই। 

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনে কাঠ ও স্টিল মিশ্রণে নির্মিত লঞ্চ স্টিলবডিতে রূপান্তরিত হলে এবং সেগুলোর স্ট্যাবিলিটি বুকলেট অনুযায়ী উপযুক্ততা পাওয়া গেলে তা অনুমোদন পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ আদেশের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য সানকেন ডেকবিশিষ্ট লঞ্চ চলাচল করছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনাকবলিত এমএল আফসার উদ্দিন ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়। তখন এটি কাঠের ছিল। পরে ১৯৮৪ সালে পুনর্নিমাণ করা হয়। এ লঞ্চটির বয়স ৪৯ বছর।

নৌ-মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানিয়েছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে সম্প্রতি স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেটিরও নিবন্ধন বা রুট পারমিট কোনোটি ছিল না। যে বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে, তার নাম এমভি সাফিন সায়হাম। এ জাহাজটিরও নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন ছাড়াই বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব নৌযান চলাচল করেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই চলে অবৈধ এসব নৌযান।


আরও পড়ুন