ঢাকা বৃহষ্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৩

পাত্তা পাচ্ছে না ‘গুজব’


সাজেদা হক       photo সাজেদা হক
প্রকাশিত: ২০-২-২০২৩ দুপুর ২:১৯

*    ইউটিউব, ফেসবুক প্রধান হাতিয়ার
*    বিদেশে বসে ছড়ানো হচ্ছে এসব গুজব
*   ব্যয় করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা

সাম্প্রতিক সময়ে ‘গুজব’ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে। সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাতে বিশ্বব্যাপী ‘দেশের সুনাম’ ক্ষুণ্ন করতেও দ্বিধা করছেন না বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা। আর ডিজিটাল বিশ্বের প্রধান হাতিয়ার ‘ইন্টারনেট’-এ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এইসব বহুমুখী ‘গুজব’। ব্যয় করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ‘গুজব’ ছড়ানো এখন পেশাতেও পরিণত হয়েছে। পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে ‘গুজব’ ছড়ানোর জন্য দেশে ও দেশের বাইরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ‘নেত্র নিউজ’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একই মতাদর্শে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে নাগরিক টিভি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানও। পাশাপাশি একাধিক সাংবাদিক দেশের বাইরে গিয়ে, দেশপ্রেমের নামে নিজস্ব ব্লগ/ইউটিউব চ্যানেল খুলে ‘গুজব’-এর প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বসেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সেইসব গুজব ছড়িয়ে দেন। আর এসব ‘গুজব’ এর মূল টার্গেট হলো সাধারণ মানুষ। সাময়িক সময়ের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। অবশ্য ‘গুজব’- তেমন একটা ‘পাত্তা’ পাচ্ছে না। 
কেন এবং কারা?

মূলত ফেসবুক, ইউটিউব বা অন্যান্য মাধ্যমের পোস্টে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয় এসব গুজব। সেসব পোস্ট অনেকেই জেনে বা না জেনে শেয়ার করছেন। এক সময় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে সমাজে। তৈরি করছে অস্থিরতা। পরিকল্পনাকারী সফল হলেও একদিকে যেমন অনিরাপদ হয়ে উঠছে এ মাধ্যমটি, ঠিক তেমনি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে অনেকেই জড়িয়ে যাচ্ছেন বেআইনি কাজে। জড়িয়ে পড়ছেন সাইবার অপরাধে। কেউ এসব অপরাধ করছেন জেনেশুনে। বিদেশে বা নিরাপদ দূরত্বে বসে প্রচার করছে বিকৃত তথ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া অনেক  পোস্ট এমন অশ্লীল, আক্রমণাত্মক এবং অরুচিকর যা শুনলেও গা গুলিয়ে যায়।  দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে, কিন্তু এরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে নানা কর্মকৌশল নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি সরকার পক্ষও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাঠের রাজনীতিতে। দুই পক্ষের সক্রিয়তায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন। কৌশল হিসেবে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার চেষ্টা করছে বিরোধী দল। এজন্য তারা বিভ্রান্তি কিংবা গুজবেরও আশ্রয় নিচ্ছে।
নির্বাচিত ‘রাষ্ট্রপতি’ অবৈধ সাম্প্রতিক সময়ে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিতে আবারো তৎপর ‘গুজব’ ছড়ানো সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিরা। নির্বাচিত ‘রাষ্ট্রপতি’ বৈধতা নিয়ে আবারো ‘গুজব’ এর নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। বলছেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নির্বাচন অবৈধ, কারণ হিসেবে এই পদটিকে নানাভাবে ‘লাভজনক’ পদ হিেিসবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া তারা। অথচ নির্বাচিত এবং নিয়োগের পার্থক্যটা বুঝতেই চাচ্ছে না। তারচেয়েও বিষয় মিমাংসিত একটি বিষয়কে এখন নতুন করে বিতর্কিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন ‘গুজব’ তৈরিকারীরা। 

অর্থ সংকটে বাংলাদেশ কিছুদিন আগেই ব্যাংকে টাকা রাখলেই আর ফেরত পাওয়া যাবে না মর্মে নানাভাবে তথ্য-উপাত্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মাধ্যমে তা ছড়িয়েছেন ‘গুজব’ তৈরিকারীরা। সেই গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে কেউ কেউ সরকারি চ্যানেল বাদ দিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। যার প্রভাবও ছিল বেশ লক্ষণীয়। কিন্তু ভুল তথ্য কিংবা বিভ্রান্তির মেয়াদ তো ক্ষণস্থায়ী, কারণ সত্য চিরন্তন। ফলে বিভ্রান্তি কাটিয়ে দ্রুতই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ গুজব ছড়ানো হয়েছিল দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে। অর্থ সংকটে নাকি বন্ধ হয়ে যাবে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। একটি পত্রিকার রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বিদেশে বসে কিছু ব্যক্তি এই গুজবের ডালপালা ছড়ায়। একাধিক টিভি চ্যানেল ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবার পর গ্রাহকদের সম্ভাব্য ভোগান্তি নিয়ে আগাম সংবাদ ও শঙ্কা প্রকাশ শুরু করে। ডাকা হয় বিশেষজ্ঞদের। সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে তারাও বিজ্ঞ মতামত প্রকাশ শুরু করেন। মানুষের মনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা দ্বিধায় পড়ে যায়। অনেকে টাকা তুলে নেওয়ারও চেষ্টা করে। গুজব এতটাই ডালপালা মেলেছিল যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হয়।

শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতি হবে বাংলাদেশের

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট চলছে বিশ^জুড়ে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। উপমহাদেশে শ্রীলঙ্কা পরিণত হয়েছে অনেকটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে। পাকিস্তানের অবস্থাও নাজুক। ভারত এগোচ্ছে খুবই সাবধানে। বাংলাদেশও এই সংকটের বাইরে নেই। সরকার গ্রহণ করেছে ব্যয় সংকোচন নীতি। বিলাসী পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধ। জরুরি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে এলসি খোলার ক্ষেত্রে। সরকারপ্রধান নিজে ব্যয় কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই সুযোগটি নিয়েছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গণঅভ্যূত্থানের সময় বিরোধী দল এবং তাদের সমর্থকরা বাংলাদেশও তেমন একটি পরিস্থিতির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে আতঙ্ক। অস্থিরতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশেও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি তৈরির একটি পরিকল্পনা থেকেই পরিকল্পিত এই প্রচার চালানো হয়েছে। 

চাঁদে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী

এর আগে ‘চাঁদে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ছবি দেখা গেছে’ এমন গুজবে বগুড়ায় তোলপাড়ের ঘটনা সবারই মনে থাকার কথা। মসজিদের মাইকে এই ঘোষণা দিয়ে এই গুজব ছড়ানো হয়। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী তখন জেলে। তার ধর্মীয় বক্তৃতা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। গুজবের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রাণ মানুষের এই আবেগকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করা। গুজবে সাফল্যও এসেছিল। মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, যা সেই সময় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব  ফেলে। এই প্রচার কি নিছক গুজব ছিল? নিশ্চয়ই না। এটি ছিল মাঠের আন্দোলন চাঙ্গা করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল।

সন্ত্রাসী তাণ্ডব রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল গুজব। সময়টা ছিল ২০১৪ সাল। বিএনপি-জামায়াত মিলে সারাদেশে সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালায়। হরতাল-অবরোধের নামে চলে অগ্নিসন্ত্রাস। বাসে আগুন, বাড়িঘরে হামলা, গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি ছিল দৈনন্দিন কর্মসূচি। অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা এই আন্দোলন চলে মাসের পর মাস। এক পর্যায়ে দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ালে তাদের এই জ¦ালাও-পোড়াও বন্ধ হয়। শুধু বগুড়ায়ই নয়, এমন ষড়যন্ত্র বিভিন্ন সময় সংঘটিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গুজব ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা  তৈরির ষড়যন্ত্র। কক্সবাজারের রামুতে গুজব ছড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল বৌদ্ধপল্লী। লালমনিরহাটে একজনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল গুজবের কারণে। কুমিল্লা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুজব ছড়িয়ে শারদীয় দুর্গা উৎসবের প্রতিমা ভাঙচুরের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। এগুলো খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। 

পদ্মা সেতুতে ‘মুণ্ডু চাই’ হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণে মানুষের রক্ত ও মাথা লাগবে। আর এই মাথা ও রক্তের যোগান দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে ছেলে ধরা হচ্ছে বলে গুজব রটে। এই গুজবটি মুহূর্তের মধ্যেই দেশব্যাপী আলোড়ন ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের চাঁদগেটে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। ওই যুবকের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। এছাড়াও মাথা, চোখের নিচে ও মাথার পেছনে গভীর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। হঠাৎ করে ওই যুবককে ‘ছেলেধরা’ হিসেবে সন্দেহ করে বসে কয়েকজন। এ কথা শুনে কোনও ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই স্থানীয়রা ওই যুবককে গণধোলাই দিতে শুরু করে বলে পুলিশ জানায়। একই সালে উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজার এলাকায় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর তথ্য জানতে স্থানীয় একটি স্কুলে যান তাসলিমা বেগম রেনু নামের এক নারী। এ সময় তাকেও ছেলেধরা সন্দেহে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে টেনে বের করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পরে মিনু মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি টাঙ্গাইলের কালিহাতীর সয়া হাটে মাছ ধরার জাল কিনতে গিয়ে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারও মৃত্যু হয়।ভোলায় ‘তৌহিদি জনতা’র সংঘর্ষ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরের ঈদগাহ মসজিদ চত্বরে ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে কটূক্তির অভিযোগে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে সংক্ষিপ্ত মোনাজাতের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শেষ করা হলে পরে আসা লোকজন মোনাজাত পরিচালনাকারী দুই ইমামের ওপর চড়াও হয়। এতে বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় গ্রামবাসী। প্রাণ বাঁচাতে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে ৪ জন নিহত ও ১০ পুলিশসহ দেড়শতাধিক আহত হন। অথচ এ ঘটনার পেছনেও ছিল ছিল একটি গুজব। এক সংখ্যালঘু যুবকের ‘হ্যাকড হওয়া’ ফেসবুক আইডি থেকে মহানবীকে (সা.) নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে গুজব ছড়ায় একটি কুচক্রি মহল। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতেই এই বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

নিখোঁজ স্যাটেলাইট
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুজব হল ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি খবর বেনামী কিছু ওয়েবপোর্টাল ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল এক বিবরণীতে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ’ শিরোনামের খবরটি গুজব বলে নিশ্চিত করে।

ভুয়া নোট

এক পাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য পাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ছবি সম্বলিত নতুন ১০০ টাকার নোট বাজারে আসছে বলে গুজব ছড়ায়। পরে সেই নোটের একটি ছবিও ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় এই তথ্য ভুয়া।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে হারপিক
হঠাৎ করেই গুজব ছড়িয়ে পরে যে, ৫০০ গ্রাম হারপিক ও ৫০০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার একযোগে ঢাললে ড্রেনে যত মশা আছে সব মরে যাবে। ফেসবুকে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিশেষজ্ঞরা জানান, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। হারপিকের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও বলে এটা গুজব।

শাপলা চত্ত্বর
ঢাকার শাপলা চত্বরে যৌথ বাহিনীর অপারেশনে হেফাজতে ইসলামীর কর্মীদের মৃতের সংখ্যা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, গণমাধ্যমের সামনে ওই অপারেশন পরিচালিত হয়, নিহতের ব্যাপারে  যে খবর ছড়ানো হচ্ছে তা গুজব।

মধ্যযুগের ‘গুজব’ 
১৩২১ সালে ফ্রান্সে গুজব রটে যে, শরীরের মাংস পচে যাওয়া বা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ইহুদি রোগীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কুয়ার পানিতে এই রোগের জীবাণু মিশিয়ে দিচ্ছে। আরও বলা হয়, মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ইহুদিদের অর্থায়নে কুষ্ঠরোগীরা পানিতে এই রোগের জীবাণুর বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এ কাজে স্বয়ং শয়তান জড়িত বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। এই গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা শুরু হয়। জনতার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বহিরাগত, বিদেশি, ভিক্ষুক, তীর্থযাত্রীদের ওপর। মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশুদের বলি দেয়। কালো প্লেগের যুগে এই ধরনের গুজব বিশাল ক্ষতি ডেকে এনেছিল। জিপসি, কুষ্ঠ ও সোরিয়াসিসের রোগীদের মেরে ফেলা হয়েছিল অকাতরে। সে সময় অসংখ্য মানুষকে নানা কায়দায়, বিশেষ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

ইনফ্লুয়েঞ্জা জীবাণু জার্মান সেনাবাহিনীর অস্ত্র
১৯১৮-২০ সালে আড়াই কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কার করে- অনেকেই বিশ্বাস করতেন এই তত্ত্ব। সে সময় বিশ্বজুড়েই নেমেছিল অন্ধকার। এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না সে সময়। তাই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয় বেশি। তাই সে সময় জার্মানবিদ্বেষীরা দাবি করা শুরু করে ইনফ্লুয়েঞ্জা জীবাণু জার্মান সেনাবাহিনীর তৈরি। তারাই পরিকল্পিতভাবে এই জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই সে সময় এই কথা বিশ্বাস করেছিল। 

ভারতে বানরমুখো মানুষের আক্রমণ
২০০১ সালের কথা। ঘটনাটি দিল্লির। সে বছর দিল্লিতে বানরের মতো দেখতে একটি জীবের রিপোর্ট দেখা যায়। এ নিয়ে তখন ব্যাপক হইচই তৈরি হয়। অনেকে বলেন, জীব বা ব্যক্তিটি লম্বায় ৪ মিটার। লোকটি কালো পশমের একটি ধাতুর হেলমেট আর ধাতুর থাবা ব্যবহার করত। অনেকটা রোবটের মতো। ১৩ মে ২০০১ সালে এটি ১৫ জনকে আহত করে এবং প্রচুর আতঙ্ক  তৈরি করতে সমর্থ হয়। আশপাশের অনেকেই জন্তুসম এই জীবের মুখোমুখি হয়েছিল বলে দাবি করে। প্রত্যেকেই তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। তবে কেউই এর ছবি তুলতে পারেনি। যেমন করে এসেছিল, ঠিক তেমন করেই হারিয়ে যায় এই অদ্ভুত জীবটি। ফলে এর পেছনে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাত রয়েছে কি না সে তথ্য জানা যায়নি।

ডাইনি অভিযোগে শত শত হত্যা
ইউরোপে ৩০০ বছরে অন্তত ৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল ৬০ হাজার। তবে আফ্রিকাসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে উইচ হান্ট বা ডাইনি নিধন এখনো চলছে। ১৯৯৮ সালের শরতে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে জাদুকরী মানুষের গুজব বেশ কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। গুজবে কান দিয়ে দেশটির বানিয়াঙ্গি অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে কালা জাদুকরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে যেসব মানুষের ওপর কালা জাদুকরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয় জেলা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গুজবে উন্মত্ত জনতা পুলিশ স্টেশন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় অভিযুক্তদের এবং নৃশংসভাবে গণপিটুনি দিয়ে তাদের হত্যা করে। এমন নজির ইতিহাসে আরও অনেক রয়েছে। ভারতে এ নিয়ে আইন করা হয়েছে। 

মিথ্যাকে সত্য বানানো জোসেফ গোয়েবলস
মিথ্যাকে সত্য বানানোর রাজা জোসেফ গোয়েবলস। মিথ্যাকে সত্যের মতো গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করা, গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কলাকৌশল দেখিয়েছেন তিনি। গুজব ছড়ানো ও বিভ্রান্ত খবর পরিবেশনার কথা উঠলে তার নাম উচ্চারিত হবেই। হিটলারের সময় তিনি ছিলেন নাৎসিদের প্রপাগান্ডামন্ত্রী ও প্রচারণা বিশেষজ্ঞ। মিথ্যাকে এমনভাবে প্রচার করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে গোয়েবলস নাৎসিবাদ ও হিটলারকে জার্মানিতে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি দ্য লিটল ডক্টর নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময় গোয়েবলস ডিক্টেশন দিয়ে একটি ডায়েরি লিখিয়েছিলেন। গোয়েবলস তার লেখনী, সভা-সমাবেশের পোস্টার,  স্লোগান, বক্তৃতা, ছবি, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে ভুল তথ্য সংযোজন করে প্রচার করতেন।
রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এমন গুজব ছড়ানো মারাত্মক অপরাধ। তাই কেউ গুজব বা এ ধরনের পোস্ট ছড়ালে যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এক্ষেত্রে অপরাধীকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানো অপরাধে। এছাড়াও গুজব প্রতিরোধে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘ফ্যাক্ট চেকার টিম’ গঠন করতে পারে। যাদের কাজ গুজব শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা। দেশে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ ইউনিট রয়েছে। তাদের আরও বেশি তৎপর হতে হবে। অর্জন করতে হবে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা।  ফেসবুক ব্যবহারকারীরা রিপোর্ট করে গুজব প্রতিহত করতে পারে। এজন্য তাদের আরও সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিটি নাগরিকের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। গুজব এবং অপপ্রচার শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজেও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির মাধ্যম হয়ে উঠছে দিন দিন। এদের রুখতে হবে। দমন করতে হবে কঠোর হাতে।

 

এমএসএম / এমএসএম