ভোরের দুর্ধর্ষ ডাকাত দল : পুলিশ সদস্যরাও রক্ষা পাচ্ছে না!

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ১৭-৫-২০২৩ দুপুর ৪:৯

17Views

 রাজধানীতে দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের সদস্যরা নতুন কৌশলে ডাকাতি করছে। এসব দুর্বৃত্তরা পিকআপ ভ্যানযোগে পুরো নগরী চষে বেড়াচ্ছে। আর রাজধানীর যেসব স্পটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসিটিভি নেই, সেই সব স্পটে পথচারী বা বিভিন্ন যানবাহনে চলাচলকারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হচ্ছে। এরপর তাদের কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের সদস্যদের কেউ যদি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন, তাহলে তাকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এতে যদি তিনি মারা যান, তাহলে তার লাশটি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আর এই ডাকাত দলের সদস্যরা বিশেষ করে ভোররাতের দিকেই ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটাচ্ছে। এ ধরনের ডাকাত দলের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। নগরীতে ভোররাতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করা একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতারও করেছে পল্টন থানা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- সোহেল (৩০), আক্তার ওরফে সোহরাব (৩২), আবির হোসেন ওরফে রাসেল (২৫), মো. রনি (২৮)।
পুলিশ জানায়, রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় চাঞ্চল্যকর একটি ডাকাতির মামলা তদন্ত করতে গিয়ে গ্রেফতারকৃত ডাকাত দলের সদস্যদের তথ্য পায়। এরপর ডাকাত দলের সদস্যদের শনাক্ত করে পল্টন মডেল থানা পুলিশ। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত সোমবার রাজধানীর মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। আর এই চক্রটিকে গ্রেফতার ও শনাক্ত করতে প্রায় শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ। একপর্যায়ে গত সোমবার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে ডাকাত দলের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্র, পিকআপ ভ্যান ও ডাকাতি করা টাকা এবং ৪টি স্মার্টফোন, ৩টি বাটন মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। এই ডাকাত দলের সদস্যরা বিশেষ করে ভোররাতে নগরীতে চলাচলকারীদের টার্গেট করতো। এরপর ডাকাতির জন্য প্রথমে একটি পিকআপ ভ্যান ছিনতাই করে। এরপর পিকআপ নিয়ে রাস্তায় চলাচলকারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল, টাকা ও ব্যাগসহ মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই ডাকাত চক্রের হাত থেকে পুলিশ সদস্যরা রক্ষা পাননি। 
জানা গেছে, গত ১২ মে ভোররাতে ডাকাত চক্রের খপ্পরে পড়েন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) একজন নারী কনস্টেবল। একই রাতে ধানমন্ডি এলাকায় একইভাবে আরেকটি দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটনা। এছাড়া গত ১৩ মে তেজগাঁও ও বনানী থানা এলাকায় একইভাবে আরও দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটায় তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে এই ডাকাত চক্রটি নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পিকআপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে আসছিল। দুর্বৃত্তরা ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পিকআপ ভ্যানটিও ছিনতাই করে। আর ডাকাতির ঘটনা ঘটানোর পর দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতো তারা। এসব ঘটনায় অনেকেই থানায় অভিযোগ না করার কারণেই গ্রেফতারকৃতরা একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েই আসছিল। তবে ডাকাতদের প্রত্যেকে বিরুদ্ধে ডাকাতি, দস্যুতা, চুরি ও মাদকের মামলা রয়েছে। জামিনে বেরিয়ে এসে তারা ফের ডাকাতি কাজে লিপ্ত হতেন।
মতিঝিল বিভাগের ডিসি আরো বলেছে, গত ১২ মে ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) নারী কনস্টেবল নার্গিস আক্তার (৩৩) রিকশায় করে ভিভিআইপি ডিউটির উদ্দেশে অফিস যাচ্ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনের মোড়ে পৌঁছামাত্র পেছন থেকে আসা একটি হলুদ ও নীল রংয়ের পিকআপ তার রিকশাকে চাপ দেয়। তখন পিকআপের পেছন থেকে দুজন লোক নেমে এসে তাদের একজন ওই পুলিশ সদস্যের হাত ধরেন এবং অপরজন গলায় ধারাল অস্ত্র ধরেন। এসময় নারী পুলিশ কনস্টেবলকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার গলায় থাকা ১০ আনার একটি সোনার চেন ও হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। আর তার ব্যাগে নগদ ৫ হাজার টাকা, ৪৫ হাজার টাকার একটি শাওমি নোট-৮ স্মার্টফোন, একটি বাটন ফোন ও এসবির আইডি কার্ড ছিল। ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পিকআপটি শাহজাহানপুরের দিকে চলে যায়। এঘটনায় ভুক্তভোগী নারী পুলিশের কনস্টেবল পল্টন মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আর সেই মামলার প্রেক্ষিতে মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. রওশানুল হক সৈকতের নেতৃত্বে পল্টন মডেল থানার একটি বিশেষ টিম রাজধানীর শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। একপর্যায়ে মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতরা ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পিকআপ ভ্যানটি গত ৫-৬ দিন আগে ছিনতাই করে নিজেদের দখলে নেয়। এরপর ছিনতাই করা ওই পিকআপ নিয়ে গভীর থেকে ভোর পর্যন্ত চলাচলরত পথচারী, রিকশা আরোহীদের সুবিধাজনক স্থানে গতিরোধ করে। এরপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতি করে আসছিলেন। এছাড়া, গত ১২ মে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। আর গত ১৩ মে তেজগাঁও ও বনানী থানা এলাকায় একইভাবে আরো দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। গ্রেফতারকৃত সোহেলের বিরুদ্ধে ২টি মামলা রয়েছে। আক্তার ওরফে সোহরাবের বিরুদ্ধে ৬টি, আমির হোসেন ওরফে রাসেলের বিরুদ্ধে ৫টি, রনির বিরুদ্ধে ৮টি মামলা রয়েছে। আর এদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা বলে জানা গেছে। 
ডিসি হায়াতুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা শহরকে আমরা অনিরাপদ বলবো না। কিন্তু রাতে ট্রাক, পিকআপ চলাচল করবে এটা বাস্তবতা। তবে চেকপোস্টে চেক করলে খালিই পাওয়া যায়। আবার নগরীর সব স্থানে তল্লাশি বা নজরদারি থাকে না। আর এসব সুযোগ নিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। নগরীতে চলাচলকারী প্রায় প্রত্যেকটি ট্রাক, পিকআপ চেক করা, নজরদারি বাড়ানো, চেকপোস্ট সক্রিয় রাখার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। আর এসব বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে নবীনগর থেকে একটি বাস ছিনিয়ে নিয়ে রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যাত্রী তুলে ডাকাতির অভিযোগে জড়িতদের চিহ্নিত করে ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এই ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অগোচরে ছিল বলে জানা গেছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃতরা দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের সদস্য। এদের দলনেতা খুবই ভয়ংকর। রাজধানী ও এর আশপাশে খুবই হিংস্রভাবে ডাকাতি করে। এই চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে একইভাবে বাস লুট করে ডাকাতির অভিযোগ মামলা রয়েছে। ওই সব মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় একই পথে নামে। ১২ ফেব্রুয়ারি বাস ডাকাতির ঘটনায় গত ২ মার্চ রাজধানীর দারুস সালাম থানায় ভুক্তভোগী মো. নাসরুল (৩২) মামলা করেন।
সেই সূত্রে জানা গেছে, নাসরুল রিসাত পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-গ-১৩-০৫৯২ বাসটি গাজীপুর থেকে ছেড়ে কোনাবাড়ী-নবীনগর-গাবতলী-যাত্রাবাড়ী-পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা রুটে চলাচল করে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রী না থাকায় বাসের মালিক পক্ষের নির্দেশে দারুস সালাম থানাধীন গাবতলী পর্বতা সিনেমা হলের ডানপাশে রাস্তার ওপরে বাসটি স্ট্যান্ড করা হয়। এরপর বাসের দরজা লক করে ভেতরে বাসের চালক ও তার সহকারী এবং সুপারভাইজার পেছনের সিটে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে ৮ থেকে ১০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির গাড়ির দরজা কৌশলে খুলে বাসে অতর্কিতভাবে উঠে পড়েন। এরপর বাসটির চালক ও হেলপারের হাত পেছনে বেঁধে লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। এসময় তাদের মধ্যে একজন বাসের চালকের সিটে গিয়ে বাস চালিয়ে শ্যামলীর দিকে যেতে থাকে। আর অন্যরা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উঁচিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের ফোন ও টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। এরপর সবার চোখ বেঁধে বাসের পেছনের সিটের ওপর ফেলে রাখা হয়। আর তারা কোনো কথা বলতে গেলেই ডাকাতরা ক্ষিপ্ত হয়ে পুনরায় মারধর করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম ছাড়াও হত্যার হুমকি দেয়। উক্ত বাসটি চলন্ত অবস্থায় বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে তাদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বলে যে, আমরা ডাকাত চুপ করে থাকতে বলা হয়। যা চাই তা দিয়ে দে, নইলে তোদের জীবন শেষ করে দেব। তারপর ডাকাত দলের সদস্যরা সাভারের কবিরপুর এলাকায় নেমে যায়। কিছুক্ষণ পর ডাকাতদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একে অন্যের হাতের বাঁধন খুলে দেখেন আরও কয়েকজন যাত্রীকে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের নাম ডা. শাওন চৌধুরী জয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের সামনে থেকে তিনি ওঠেন বলে জানান। ডাকাতরা যখন তাদের ছেড়ে চলে যায় তখন সময় ভোর সাড়ে ৬টা। ভুক্তভোগী রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি জানান, তার চোখ বেঁধে বাসের পেছনে নিয়ে বসিয়ে রাখে। তার কাছে থাকা ১২ প্রোম্যাক্স আইফোন, ৭ আইফোন, নগদ সাড়ে চার হাজার টাকা, হাতঘড়ি ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড নিয়ে যায় ডাকাত দল। শুধু তাই নয়, তাকে মারধরও করা হয়েছে।


আরও পড়ুন