বিদ্যুৎ আসে যায়

news paper

ইউসুফ আলী বাচ্চু

প্রকাশিত: ১৭-৫-২০২৩ দুপুর ৪:১১

57Views

সারা দেশে দীর্ঘসময় জুড়ে লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ এখন এই আসে, এই যায়। আর এ আসা-যাওয়ার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রাজধানীসহ দেশের বিদ্যুৎ গ্রাহকরা। এতে অনেক এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। একদিকে যেমন গরমের কারণে বিদ্যুতহীন অবস্থায় ঘরে থাকা যাচ্ছে না, তেমনি ক্ষেতে ঠিকমতো সেচ দিতে পারছেন না কৃষক। সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলনায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও বাস্তবে এই ঘাটতি আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে তীব্র গরমের মধ্যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। বলা হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় উৎপাদন কমেছে, তবে তাড়াতাড়ি এ সমস্যার সমাধান হবে।

গত শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সতর্কতার অংশ হিসেবে মহেশখালীর ভাসমান দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে এসেছে। এতে করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় এলাকায় লোডশেডিং আরও কয়েক দিন চলবে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে।

গ্যাসের সরবরাহ কমায় চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ফলে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন কমতে থাকে। গ্যাসচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে দিনে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এখন তা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেছে। এতে লোডশেডিং তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।

বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, গতকাল দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে দুপুর ১২টায় ৯ হাজার ৭৭৪ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং হয়েছে ২ হাজার ১২৬ মেগাওয়াট। এর আগে শনিবার রাত ১২টায় লোডশেডিং হয় প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট।

তবে গ্রাহক পর্যায়ে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার তথ্য বলছে, লোডশেডিং হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) একাই সর্বোচ্চ লোডশেডিং করেছে ২ হাজার ২৭০ মেগাওয়াট। শনিবার ঢাকাতেও পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে দুই বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)।

রাজধানী পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। দেশে বর্তমানে এস এস সি ও সমমানের পরিক্ষা চলছে তার মধ্যে এমন অবস্থা। শিশুরা এবং বয়স্করা আছে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।মহাখালী হাজিবাড়ি এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী হাসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে ঢাকায় তীব্র গরম। এজন্য কিছুক্ষণ পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেলে বাসায় বসে থাকার উপায় থাকে না। গরমে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।তিনি বলেন, গরমে আগের মতোই অবস্থা। যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। গরমে নগরবাসীর মরার অবস্থা তৈরি হয়েছে। পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। ওই এলাকার লোডশেডিং নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। আলাপকালে তিনি বলেন, ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকায় মনে হয় সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়। সারা বছরই এ এলাকায় এমন পরিস্থিতি হয়। মধ্যে রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘুম ভেঙে যায়।

মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় রাতে অন্তত চারবার লোডশেডিং হয়েছে বলে মুঠোফোনে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা মোতাহার হোসেন। তিনি বলেন, সাধারণত লোডশেডিং হলে ছয় তলা বাড়িতে জেনারেটর চালাই। কিন্তু ইদানিং লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানিও বেশি লাগছে। এমন পরিস্থিতি আর কতদিন চলবে আল্লাহই ভালো জানে।

পান্থপথের মুদি দোকানি সালাউদ্দিন। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসা পরিচালনায় সমস্যা হওয়ায় সম্প্রতি চার্জার ফ্যান কিনেছেন তিনি। তবে লোডশেডিং এবং গরমে এ ফ্যানও তেমন কাজ করে না বলে জানিয়েছেন। সালাউদ্দিন বলেন, ফ্যানটা পুরোপুরি চার্জ হতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। তখন এটা দিয়ে এক ঘণ্টার মতো চালানো যায়। কিন্তু দুই-তিন ঘণ্টা পরপরই লোডশেডিং হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ফ্যানও কাজ করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে অবস্থা আরো খারাপ।

বরগুনা: বরগুনার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, প্রতিদিন পাঁচ ছয় ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকে না। পোলাপান পড়াশুনা করতে পারে না, গভীর রাতে বিদ্যুৎ চলে যায়, গরমে ঘরে কেউ ঘুমাতে পারে না। রাজশাহী, ফরিদপুর, রংপুর, বরিশালে কথা বলে অনেকটা একই চিত্র পাওয়া গেছে।

এদিকে পাবনা জেলা সদর ও বেশ কয়েকটি উপজেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। জেলা শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও বেশি। অনেক এলাকায় ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে একদিকে যেমন বাড়িতে মানুষ গরমে পুড়ছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে জমিতে সেচকাজ। আবার ঈদ উপলক্ষে বিপণি বিতানগুলোয় বেচাকেনায় চরম বিড়ম্বনা তৈরি হচ্ছে। অনেকে গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

পাবনা জেলা শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্রে জানা গেছে, শহরে নেসকোর দুটি ইউনিটের মধ্যে ইউনিট-১এ দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২৬ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুতের সরবরাহ মিলেছে ২০ মেগাওয়াট। ইউনিট-২এর বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৯ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ মিলেছে ১৪ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের ভাষ্য, ‘পিক আওয়ারে’ বিদ্যুতের এই চাহিদা অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুতের ঘাটতি থাকছে।

জেলা শহর ও আশপাশের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফসলের মাঠ থেকে বাজার সব জায়গাতেই লোকসমাগম কম। প্রয়োজন ছাড়া যেন কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। তবে ঈদ সামনে রেখে শহরের বিপণিবিতানগুলোয় রয়েছে মানুষের ভিড়। তবে অধিকাংশ বিপণিবিতানে ঢুকলেই কানে আসছে জেনারেটরের আওয়াজ। বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করেই চলছে কেনাকাটা।

অপরদিকে লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে বোরোর ক্ষেতেও। জেলা সদরের মনোহরপুর গ্রামের বাবুল আক্তার বলেন, মনোহরপুর মাঠে বোরো আবাদের জন্য সমিতির মাধ্যমে তাঁরা ৪৫ জন কৃষক একটি গভীর নলকূপ বসিয়েছেন। পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ নিয়ে জমিতে সেচ দেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে চরম লোডশেডিং থাকায় ঠিকমতো সেচ দিতে পারছেন না। একদিকে তাপপ্রবাহ, অন্যদিকে সেচ না দিতে পারায় পানি শূন্য হয়ে ধানের জমি ফেটে যাচ্ছে।
বাবুল আক্তার বলেন, ‘জীবনে এমন লোডশেডিং দেখিনি। আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পাচ্ছি না। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

 


আরও পড়ুন