রাজপথে সংঘাত

news paper

ইউসুফ আলী বাচ্চু

প্রকাশিত: ২১-৫-২০২৩ দুপুর ৪:১১

24Views

*    পটুয়াখালী ও রাজবাড়ীতে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে শতাধিক আহত
*   খুলনায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ
*   সাধারণ মানুষ শঙ্কিত
*    আরও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপির পালাপাল্টি হুংকার অবশেষে সংঘাতে রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ এবং বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার পটুয়াখালী ও রাজবাড়ীতে দল দুইটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এর আগে শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় খুলনায়। সেখানে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দল দুইটির মারমুখী অবস্থানের কারণে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। আরও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। 
জানা গেছে, ক্ষমতাসীনরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখার রোডম্যাপ তৈরি করেছেন। সরকার পতনের আন্দোলন থেকে পিছপা না হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। যদিও আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচিকে বিরোধী দলের পাল্টা কর্মসূচি বলতে নারাজ। কিন্তু দলটির নেতারা যেসব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তাতে বিরোধী দলের কর্মসূচিই যে তাদের লক্ষ্য, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বরাত দিয়ে রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, সকাল ১০টায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় প্রাঙ্গণে ‘শান্তি সমাবেশের’ আয়োজন করা হয়। সমাবেশ শেষে দুপুর ১২টার দিকে একটি মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ। মিছিলে নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা, রড, হাতুড়ি দেখা গেছে। মিছিলটি শহরের পান্না চত্বর প্রদক্ষিণ করে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে প্রবেশ করে। মিছিল শেষে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী বিএনপির কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বহনকারী গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বিএনপির কার্যালয়ে পৌঁছে দেয়। আওয়ামী লীগের মিছিল শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর বিএনপির কার্যালয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এ সময় শহরের বড়পুল এলাকায় বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম একটি মিছিল নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে আসছিলেন। এতে প্রথমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। কিছু দূর আসার পর সিংগার মোড়ে পুলিশ মিছিলে লাঠিপেটা করে কয়েকজনকে আটক করে। এরপর বিএনপির নেতা আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম নেতাকর্মীদের নিয়ে বাড়িতে চলে যান। দুপুর সাড়ে ১২টায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক লিয়াকত আলীর সভাপতিত্বে জনসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন প্রদর্শন করা হয়।

বিএনপির নেতা জয়নুল আবেদিন আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের যদি রাজনৈতিকভাবে লজ্জা থাকত, তাহলে আমার গাড়িতে হামলা করতেন না। আমি ২৫৭ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছি। নোয়াখালী থেকে পাঁচবার এমপি হয়েছি। আমার গাড়িতে হামলার বিচার আপনাদের কাছে দিয়ে গেলাম। এভাবে আমাদের আন্দোলন দমানো যাবে না।বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিএনপির নেতা আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ। বাড়ির সামনের রাস্তায় ইটের টুকরা ছড়ানো-ছিটানো। বাড়ি থেকে প্রায় একশ মিটার দূরে প্রধান সড়কে গাড়ি নিয়ে অবস্থান করছে পুলিশ। সেখানে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা থাকলেও বিএনপির নেতাদের আটকের বিষয়ে তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নিতে দলীয় কার্যালয়ে যাচ্ছিলাম। পথে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ আমাদের বাধা দেয়। এরপরও আমরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। গুলি ছোড়ে। হামলায় আমাদের অনেক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া জেলা মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারজানা ইয়াসমিনসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি তাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান।

রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সালাউদ্দিন বলেন, কতজন আটক বা আহত হয়েছেন, তা জানি না। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করা যাবে না।রাজবাড়ী সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সংঘর্ষের বিষয়ে বলেন, বিএনপির সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে বনানী মোড়ে দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এ সময় ভাঙচুর করা হয়েছে জেলা বিএনপির কার্যালয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। সকালে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা শহরে ‘শান্তি সমাবেশের’ মিছিল করেন। মিছিল নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিএনপির সমাবেশস্থলের দিকে এগোলে পথে দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়। এ সময় উভয় পক্ষই লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টার দিকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষের কারণে বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে সিঙ্গারা পয়েন্ট পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় জেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি মোটরসাইকেলে। দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলা এ সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ তিনটি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার অভিযোগ করে বলেন, সমাবেশের প্রধান অতিথি আবদুল আউয়াল মিন্টু যাতে সভাস্থলে পৌঁছাতে না পারেন, সে জন্য তার হোটেলের সামনে মহড়া দিয়ে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকেই যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করেছেন। এ সংঘর্ষে তাদের শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলা যুবলীগের শান্তি সমাবেশের মিছিলে বিএনপির মিছিল থেকে উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় আমাদেরও অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের শান্তি সমাবেশ থেকে ঘোষণা করছি, পটুয়াখালীতে আগুন-সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আমরা মাঠে থেকে প্রতিহত করব।  পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে এখানে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। সকাল ৯টায় সমাবেশ শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি যাতে না ঘটে, পুলিশ সে জন্য প্রস্তুত ছিল। পরে সেখানে পরিস্থিতির অবনতি হলে পুলিশ তিনটি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এদিকে, শুক্রবার খুলনা ও রংপুরে সমাবেশে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় তিন পুলিশসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। 
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিএনপির একটি কর্মীসভা ছিল। তারা খুলনা প্রেসক্লাবে প্রোগ্রাম করছিলেন। কিন্তু তাদের নেতৃস্থানীয় নেতারা আসার পর বেশ কিছু নেতাকর্মী রাস্তা বন্ধ করে প্রোগ্রাম শুরু করে। আমরা পেছনে সরে গেলেও কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী আমাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলে আমরা টিয়ারশেল এবং কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে বাধ্য হই। এছাড়া আমাদের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, বিএনপি দেশে কোনো নির্বাচন হতে দিবে না। কারণ হিসেবে তিনি সিলেটের সিটি করপোরেশনের কথা বলেন।
তিনি বলেন, সিলেটের বিএনপির মেয়র প্রার্থী রানিং ছিল। তারপরেও নির্বাচন বয়কট করেছে। কাউন্সিলরদের বহিস্কারও মোটেও ভালো লক্ষ্মণ নয়। তারা একটা মরণ কামড় দিতে চাইবে। ঢাকাকে অচল করে দিতে চাইবে- এটাই তার আলামত। এবারের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে রয়েছে। ফলে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, দুই দলই রাজপথে ততটা মরিয়া অবস্থান নিতে পারে। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে বিএনপি তাদের আন্দোলনের গতি বাড়ানোর জন্য যদি লংমার্চ বা অবরোধের মতো কর্মসূচি নেয়, ক্ষমতাসীন দলও রাজপথে সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে- এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। তখন বিরোধী দলের আন্দোলনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার আরও বেড়ে যেতে পারে। মাঠে রাজনৈতিক দিক থেকেও আওয়ামী লীগ আরও কঠোর হতে পারে। 
রাজপথে সংঘাত প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল বলেন, তারা যখন বুঝতে পারছে তাদের পায়ের তলে মাটি নেই; তখনই সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে।
তিনি বলেন, আপনার হয়তো মনে আছে, ২০১৩-১৪ সালের কথা কিভাবে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে তারা। বিএনপি জানে যে দেশের মানুষ তাদের সঙ্গে নেই, নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তারা মরিয়া। মানুষের জান-মালের ক্ষতি করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে না। অপরদিকে আওয়ামী লীগ জনগনের দল। সব সময় আমরা দেশের মানুষের কল্যানের কথা ভাবি, তাদের কল্যাণে কার কাজ করি। আমাদের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, বিএনপি বলছে- তত্ত্বাবধায়ক ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচন বানচাল করার জন্য হুংকার দিচ্ছে। কিন্তু আন্দোলন করার সেই শক্তি বিএনপির আর নেই। তারা রাজপথে সংঘাতই তৈরি করতে পারবে। মানুষের জান-মালের ক্ষতি করতে পারবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের জন্য রাজপথে আন্দোলনের ভয় দেখাচ্ছে বিএনপি। এই হুংকার দিয়ে লাভ নেই। পেছনের দরজা এবং অন্ধকার গলিপথ দিয়ে ক্ষমতায় আসার সুযোগ আর হবে না। আগামী নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গ্রহণে কমিশন সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। 

 


আরও পড়ুন