ইতালি প্রবাসীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রতারণা করে তরুণীকে বিয়ে, নির্যাতন
প্রকাশিত: ২৪-৫-২০২৩ দুপুর ৪:৪০
ইতালিতে নিয়ে চাকরির প্রলোভন ও মিথ্যা ধনাঢ্য প্রবাসি পরিচয়ে উচ্চ শিক্ষিত এক তরুণীকে বিয়ে করে প্রতারণার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, অন্যের স্বর্ণালংকার ধার করে নববধূর গলায় পরিয়ে তা গলা থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ভুক্তভোগী ওই তরুণীর নাম রিমা আক্তার। গত ৩ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামের রাজ্জাক মাতুব্বরের ছেলে সুরজ মাতুব্বরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
ইতালি প্রবাসি সুরজ মাতব্বর তার নববধূকে বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেছেন। এতে পিঠের হাড় ভেঙে গুরুতর আহত হন রিমা। পরে তাকে চিকিৎসার নামে ঢাকায় এনে ইতালির মিলানে পাড়ি জমিয়েছেন ওই প্রতারক প্রবাসি। নববধূ উপায়ন্তর না পেয়ে আহত অবস্থায় তার বাপের বাড়ি ফরিদপুরে মধুখালিতে অবস্থান করছেন। অপর দিকে প্রবাসি সুরজ এলাকার সন্ত্রাসীদের দিয়ে হুমকি দিয়ে তার বাপের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন নববধূকে। এ ঘটনায় ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী রিমা আক্তার জানান, সুরজ মাতব্বর ইতালিতে অবস্থানের সময় তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে মোবাইল নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এর কিছুদিন পরেই তিনি দেশে এসে রিমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। আর তাকে বলা হয়, বিয়ের পর তাকে ইতালি নিয়ে সেখানে চাকরি দিবেন। আর বিয়ের পর ইতালিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রিমা তার বাবার বাড়িতে অথবা ঢাকায় থাকার কথা হয়। আর এই সময়ের মধ্যে তিনি কাগজপত্র প্রসেসিং করে তাকে ইতালি নিয়ে যাবেন। তিনি যত দিন দেশে থাকবেন, ততদিন রিমাকে ভরণপোষণ দিবেন।
রিমা সকালের সময়কে বলেন, ‘আমি রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিং-এ এমবিএ করেছি। যেহেতু একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে ইতালি গেলে সেখানে চাকরি করতে পারবো। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে লোভ-লালসা দেখিয়েছেন। মূলত সে যা বলেছেন, তার সবই ডাহা মিথ্যা। আমাকে প্রলোভন দেখিয়ে বলেছেন, বিয়ের তিন মাসের মধ্যে ইতালি নিয়ে যাবেন। আর প্রতারক সুরজ অনার্স কমপ্লিট করার কথা বলেছেন, আর ভাঙ্গা হাইওয়ের পাশে তার পাঁচ তলা বাড়ি রয়েছে। এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার পরিবারের কাউকে তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে দেননি। আমার পরিবার বিশ^াস করে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। আসলে সুরজ মাতব্বর একজন প্রতারক, মিথ্যাবাদী একদমই পড়ালেখা জানে না, মূর্খ একটা মানুষ। তার বাড়িতেও তেমন কিছু নেই, যেমনটা সে বলেছিল। গত জানুয়ারির ১ তারিখ আমাকে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করেন। আর ইতালি যেতে কোর্ট ম্যারেজের কাগজ লাগার কথা বলায় আমি কোর্টে যেতে রাজি হই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে সুরজের ভিন্ন রূপ প্রকাশ পায়। বিয়ের দিন কাবিনের টাকা থেকে সে দুই লাখ টাকা উসুল লিখে দুই লাখ টাকার গহনার কথা উল্লেখ করে। কিন্তু উক্ত গহনা অন্যের কাছ থেকে ধার করা। গত ১১ জানুয়ারি সুরজ মাতব্বর ১৫০ জন মানুষ নিয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করে তাকে নিয়ে আসেন। বিয়ের দুই দিন পর আমার বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর সুরজ এর দুই বোন, তার মা, ছোট ভাইয়ের বউ একত্রে রিমার কাছ থেকে গহনা ফেরত চায়। এ সময় গহনা দিতে রাজি না হলে তারা আমাকে মারধর করে গহনা কেড়ে নেয়। আর চুল ধরে পিঠে ঘাড়ে আঘাত করায় গুরুতর আহত হই।’
রিমা আক্তার জানান, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকে। এভাবে নববধূ হওয়ার পরও তাকে মারধর করার পর তাদের বাড়িতে জিম্মি করে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, তাকে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি। তার অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ হলে স্থানীয় বাজারের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তারের কাছে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি কিছু বলার চেষ্টা করায় বাড়িতে নিয়ে গালিগালাজ করা হয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলায় তাদের বাড়ির কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি।
এভাবে সেখানে এক মাস শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে সুরজ ইতালি যাওয়ার দুই দিন আগে পুনরায় তার উপর হামলা ও মারধর এমনকি তার মাথা দেয়ালের সঙ্গে আঘাত করা হয়। এতে তিনি আহত হলেও তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়নি। পরে সুরজ ইতালিতে যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে এগিয়ে দেওয়ার কথা বলে রিমা সুরজের সঙ্গে বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিয়ে বিকালে একজন অধ্যাপক চিকিৎসককে দেখান। এতে ওই চিকিৎসক অবাক হয়ে তাকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর তিনি তার বাবার বাড়িতে গিয়ে অবস্থান করছেন। সুরজ তার চিকিৎসার জন্য খরচ দিবেন। আর মামলা না করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে কোন প্রকার খরচ দেন নাই। আর তাকে কোনোদিনই ইতালিতে নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সুরজ।
রিমা সকালের সময়কে জানান, এখন তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। তাদের বাড়িতে না গেলে তাকে কোন প্রকার ভরণপোষণের খরচ দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়।
তিনি আশঙ্কা করছেন, তাদের বাড়িতে গেলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হতে পারে। সুরজ ইতালি যাওয়ার পর তার ছোট বোন ও ছোট ভাইয়ের বউ তাকে ফোনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। তারা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। তারা রিমার বাবা-মা, বোন, ভগ্নিপতি সবাইকে ফোন দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছেন। আর তাকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এছাড়া গত ৬ এপ্রিল সুরজ এর বন্ধু পলাশকে দিয়ে ফোন করিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। আর তাদের হাত অনেক লম্বা, তারা টাকা দিয়ে সব থামিয়ে দিবে। তারা কোনোভাবে তার বাবার বাড়ি থেকে নিতে পারলেই তাকে মেরে ফেলবে বলে রিমা আক্তার আশঙ্কা করছেন। এছাড়া তাদের পরিচিত লোকজনের কাছে তার সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলা হচ্ছে।
এসব ঘটনায় ভাঙা থানায় গত ১০ এপ্রিল সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মধুখালি থানার জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ সহকারি পরিদর্শক (এএসআই) ইসলাম সরদার এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের সময়কে জানান, জিডির বিষয়টি তদন্তের জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতের অনুমতি পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগী রিমা জানান, সুরজ মাতব্বর জালিয়াতি করেই আমাকে বিয়ে করেছে। আর বিয়ের পর তার সব কিছু জেনে ফেলায় তিনি তার সঙ্গে খারাপ আচরণ ও নির্যাতন করেছেন। তার পরিবারসহ তাদের নির্যাতনের বিচার দাবি করেছেন।