ফাঁদে পড়ছেন নারীরা

news paper

আব্দুল লতিফ রানা

প্রকাশিত: ৮-৭-২০২৩ দুপুর ৩:৫৮

81Views

দেশে-বিদেশে চাকরি দেয়াসহ আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রলোভনে ফাঁদে পড়ছেন নারীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়ের পর পরকীয়ায় পড়াসহ নানাভাবেই এসব নারীরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। আবার অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করেছে না।

জানা গেছে, চাকরি দেয়ার নাম করে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে কাজী মামুনুর রশিদ নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। ওই নারীকে উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসিতে) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় রমনা থানায় পুলিশ অভিযোগ নিলেও তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি বলে অভিযোগে জানা গেছে। ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।  
জানা গেছে, পুরান ঢাকায় বাস করা ওই নারীর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ (প্যরালাইজড)। ভুক্তভোগী নারী হাইকোর্ট মাজারে গিয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। এমন সময় পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী এক ব্যক্তি তার কাছে কান্নাকাটির কারণ জানতে চান। তখন পরিবারের অস্বচ্ছলতা ও স্বামীর অসুস্থতার কথা জানালে ওই ব্যক্তি তাকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে তার ফোন নম্বর নিয়ে নেয় এবং পরবর্তীতে তাকে ফোন দেবে বলে জানান।

ওই নারীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে ওই ব্যক্তি গত ৪ জুলাই  দুপুরে ফোনে ওই নারীকে সেগুনবাগিচার জিকে টাওয়ারের ৪র্থ তলায় ডেকে নেয়। বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাকে কুপ্রস্তাব দেয়া হয়। তার কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া, ধর্ষণের বিষয়টি কাউকে জানালে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এঘটনার পর ওই নারী সেখান থেকে বের হয়ে যান। এরপর স্বজনদের ফোন করে বিষয়টি জানালে তারা শিল্পকলা একাডেমির পাশের রাস্তা থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তারা আরও জানান, আমরা জানতে পেরেছি ধর্ষণ করা ব্যক্তির নাম কাজী মামুনুর রশীদ। রমনা থানার এসআই আরিফ রাব্বানী জানান, চিকিৎসার জন্য ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনও কোনো মামলা হয়নি। মামলা হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

অপরদিকে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি বন্ধ রেস্তোরাঁয় এক তরুণীকে (২১) ধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত ধর্ষকের নাম মাহাদি হাসান ওরফে জারিফ (২৫)। বৃহস্পতিবার রাতে অভিযুক্ত মাহাদি হাসান জারিফকে (২৫) গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বরিশালে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গত রাতে বরিশালের কোতোয়ালী থানার আওতাধীন জর্ডান রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন মাহাদি। তিনি আরো জানান, গত ৩ জুলাই ধানমণ্ডি লেকে ওই তরুণীর সঙ্গে মাহাদির পরিচয় হয়। এরপর তিনি ওই তরুণীকে একটি  রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। রেস্তোরায় তখন তেমন কোন লোকজন ছিল না। আর ফাঁকা সেই বন্ধ রেস্তোরাঁর বারান্দায় নিয়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনায় পরদিন রাতেই ওই তরুণীর বাবা বাদী হয়ে ধানমণ্ডি থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। উক্ত মামলায় মাহদিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে রাজধানীর কল্যাণপুরে একটি বাসায় ১৮ বছর বয়সী এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় আকাশ (৩৪) নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ অভিযানে নেমেছেন বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার রাতেই ধর্ষিতা কিশোরীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে।

 মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহমুদুল হাসান জানান, মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়, ওই তরুণী মিরপুর মডেল থানাধীন কল্যাণপুর ১১ নম্বর রোডে আনন্দ ভবনের অষ্টম তলায় গৃহকর্ত্রী শামসুন্নাহারের বাসায় ৩-৪ বছর ধরে গৃহকর্মীর কাজ করে আসছিলেন। তবে গৃহকর্ত্রীর ছেলে আকাশ প্রায় এক বছর যাবত তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ও জোরপূর্বক ধর্ষণ করে আসছিল। আর তাকে প্রতিনিয়ত গর্ভধারণ প্রতিরোধক ওষুধ সেবন করাতো। এছাড়া, তাকে মাঝে মধ্যেই শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। তরুনীকে তাদের বাসা থেকে বের হতে দিত না। সবশেষ গত ১৫ জুন রাত ২টায় তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে আকাশ। কৌশলে ১৭ জুন ওই বাসা থেকে পালিয়ে যান তরুণী। পরবর্তীতে তারা আদালতে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর আদালতের নির্দেশে মিরপুর থানায় মামলা নেয়া হয়। তিনি আরও জানান, শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ওই তরুণীকে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেলের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্ত আকাশ পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া, মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। জানা গেছে, মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পুরাতন ভবনে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে শেখ শাকিল নামে এক পৌর ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। শাকিল মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলে জানা গেছে। ওই কিশোরীর মা বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন।

মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, মামলার আসামি পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে মামলার আসামির রাজনৈতিক পরিচয় জানতে জানাননি। তবে মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল মৃধা শাকিলের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করে বলেছেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। অভিযোগ সত্য হলে শাকিলের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে মামলার এজাহারের তথ্য মতে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দোতলার সিঁড়িতে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের আগে হাসপাতালে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। আর শাকিল হাসপাতালে আগে থেকেই অবস্থান করছিল বলে জানা গেছে। 

এছাড়া বান্দরবারের লামা থানা এলাকায় মারমা এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে লামা সদরের লেমু ঝিড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে কায়সার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বান্দরবানে লামা থানায় মারমা নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার পলাতক আসামি কায়সার।

লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী শুক্রবার বিকেলে গণমাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ধর্ষণের ঘটনার পরদিন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কায়সারকে (৩৫) আসামি করে লামা থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে লামা সদরের লেমু ঝিড়ি এলাকায় শুক্রবার বিকাল ৩ টার দিকে অভিযান চালিয়ে কায়সারকে গ্রেফতার করা হয়।

শুধু দেশেই নয়, অবলা নারীরা দেশের বাইরে গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন পদে চাকরি করতে গিয়েও বাংলাদেশীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আর এধরনের অভিযোগে সম্প্রতি একজন উপসচিব চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। সূত্র জানায়, সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রিত গৃহকর্মীদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের দায়ে মো. মেহেদী হাসান নামে এক উপসচিবকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে সরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর পদে দায়িত্ব পালনকালে এ অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। মেহেদী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তাকে এর আগে সাময়িক বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে রাখা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তের পর গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার চাকরিচ্যুতির প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

ওই প্রজ্ঞাপন সুত্রে জানা গেছে, মেহেদী সৌদি আরবে রিয়াদ দূতাবাসে কাউন্সিলরের দায়িত্বে থাকার সময় সেখানে আশ্রিত গৃহকর্মীদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় মেহেদী হাসানকে ওই পদ থেকে ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি অবমুক্ত করা হয়। তারপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে অসদারচণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দিয়ে ওই বছরের ১০ মার্চ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। গত ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল লিখিতভাবে কারণ দর্শানোর জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করেন মেহেদী হাসান। ব্যক্তিগত শুনানিতে দাখিলকরা জবাব ও বক্তব্য সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে ওই বছরের ২০ জুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

তদন্তে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে দূতাবাসের সেইফহোমে আশ্রিত কয়েকজন গৃহকর্মীকে অপ্রয়োজনীয় একান্ত সাক্ষাৎকারের নামে অশ্লীল প্রশ্ন ও আচরণসহ বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা এবং যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মেহেদীর বিরুদ্ধে অসদাচারণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী মেহেদীকে গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ওই নোটিশে কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো গুরুদণ্ড দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। আর দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর জবাবে মেহেদী তার বিরুদ্ধে আনীত এবং তদন্তে প্রমাণিত অভিযোগের বিপরীতে কোনো সন্তোষজনক বক্তব্য দিতে সক্ষম হননি। ফলে মেহেদীর দাখিল করা জবাব ও তদন্ত প্রতিবেদনসহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর সই করা প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়েই মেহেদী হাসানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।


আরও পড়ুন