ডা. নার্স কর্মচারী দালাল ও আনসার রোগীর রক্ত চুষে খাচ্ছে

রোগী মারা যাওয়া পর্যন্ত কমিশন নেয়া হয়

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৮-৮-২০২৩ বিকাল ৫:১২

241Views

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মচারী, দালাল, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, আনসার সদস্য ছাড়াও নার্স ও চিকিৎসকগণ রোগীদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবর্তে হয়রানির শিকার হয়েই ক্ষ্যন্ত হচ্ছেন না, ওষুধ কোম্পানির উপঢোকনের বিনিময়ে রোগীদের ভেজাল ওষুধ লিখে দিয়ে আরো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত করা পাওয়া গেছে। 

এসব কর্মচারী, দালালদের কাছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও জিম্মি হয়ে পড়েছেন বলে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী বলেছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কর্মচারীদের নিজ নিজ কাজে অবহেলার জন্যই হাসপাতাল পরিপূর্ণ পরিচ্ছন্ন হচ্ছে না, রোগীদের সাথে থাকা লোকদের ভিড় থামানো যাচ্ছে না, আর দালালদের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না। ফলে হাসপাতালের সেবার মানও কাঙ্খিত পর্যায়ে নেওয়া যাচ্ছে না।’ গত ৩ জুলাই দুপুরে মহাখালীস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে দেশের সকল সিভিল সার্জন ও হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কদের সাথে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক কর্মশালায় তিনি এ কথা বলেছেন।’

জাহিদ মালেক বলেছেন, প্রতিদিন সারাদেশে অন্তত ১০ লাখ সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন। আর ১০ লাখ মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য জেলা শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালও করা হয়েছে। উক্ত কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মু আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুরুতর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়। এরপর তাদেরকে নিবিড় আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে। এমন রোগীর স্বজনদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগেই বলা হচ্ছে আইসিইউ খালি নেই। এজন্য সিরিয়াল দিতে। দিনের পর দিন পার হলেও আইসিইউ খালি পায় না রোগীর স্বজনরা। অথচ হাসপাতালের দায়িত্বরত আনসার সদস্য ও দালালদের চাহিদামত টাকা দেয়ার পরই আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এভাবেই সিট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। 

অপরদিকে হাসপাতালে সেবা প্রত্যাশিদের চিকিৎসকদের কাছে যেতে দালালদের মাধ্যমে সিরিয়াল দিতে হচ্ছে। আর ওই সিরিয়ালের জন্যও অর্থ আদায় করা হয়। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন, তখন আবার ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা গিয়ে চিকিৎসকদের ওই কোম্পানির ওষুধ রোগীদের স্লিপে লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকগণ বিভিন্ন পরীক্ষার কথা লিখে হাসপাতালে মেশিন নষ্ট বলে হাসপাতালের চারপাশে গজিয়ে উঠা প্যাথলজি সেন্টারের রোগীদের পাঠানো হচ্ছে। অথচ ঢামেক হাসপাতালের এক্সে মেশিন, ইসিজি, সিটিস্ক্যানসহ কোটি কোটি টাকার মেশিন রয়েছে। এসব মেশিন ভাল থাকার পরও চিকিৎসক ও দালালগণ বাইরে পাঠাচ্ছেন।

ঢামেক হাসপাতালে দীর্ঘ সময় সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। আর এসব তথ্যের প্রত্যেক জায়গায় রয়েছে, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, কর্মচারীসহ দালাল সিন্ডিকেটের আধিপত্য। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কোন রোগী আনার পরই দালালচক্র দ্রুত সহযোগিতার নামে এগিয়ে যাচ্ছে। এরপর তাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এখানে ডা. নেই। কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই হাসপাতালে রয়েছে। সেখানে নিতে হবে, এভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা রোগীদের ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। এরপর সেই হাসপাতালে যতদিন রোগী থাকবেন, ততক্ষণ তারা কমিশনের টাকা পাবেন। রোগী সুস্থ হোক বা মারা যাক, ছাড়পত্র নেওয়ার আগ পর্যন্ত তার কমিশন পাবেন। 

সূত্র জানায়,  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ৮৬টি আইসিইউ রয়েছে। আর ৩০টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) আছে। এর মধ্যে নন-কোভিড আইসিইউ ৩২টি, কোভিড আইসিইউ ১০টি, নবজাতকের জন্য এনআইসিইউ ৩৮টি এবং ছয়টি পেডিয়াট্রিক (শিশু) আইসিইউ রয়েছে। এসব সিট ঘিরে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মধ্যে হাসপাতালের কর্মচারী নেতা, আনসার কমান্ডার এবং একজন চিকিৎসক নেতার প্রতিনিধি। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে সিটগুলো বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। 

ঢামেক হাসপাতালে সেবা নিতে আসা অধিকাংশ রোগী নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। হাসপাতালে আসার পরই তারা দালাল চক্রের নজরে পড়ছেন। দালালচক্র রোগীর আর্থিক অবস্থা অনুধাবন করে আইসিইউ বরাদ্দ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে পাঠান। এজন্য এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করাসহ সব কিছুই তারা করে দিচ্ছেন। আর যে দালাল রোগী পাঠাচ্ছেন, তাকে ওই হাসপাতাল থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন দেওয়া হচ্ছে। ঢামেকের কর্মচারী যদি রোগী পাঠান, তাকে প্রথমেই নগদ দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। আর যদি রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট  লাগে তাহলে দালালকে ১০ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালের দালাল চক্রে রয়েছেন পেট মোটা খলিল, শরিফ, সৌরভ ও সরদার মুরাদ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা রোস্টার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেন ঢামেকে। এদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঢামেকের ২১১ (সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতক), ২১২ (গাইনি বিভাগ) ও ৯৮ (অধিকাংশ দুর্ঘটনার রোগী) নম্বর ওয়ার্ডে। এসব দালালগণ কর্মচারী নেতা হান্নান গ্রুপে রয়েছেন কাওসার, দুলাল ওরফে ভেজাইল্লা দুলাল, রুবেল, মজনু, কবির, সাইমন, শামীম, নাসির, উজ্জ্বল, সবুজ, অপু, ভাগ্নে শরীফ ও রব। এছাড়া ট্যাক্সি কাশেম গ্রুপের ট্যাক্সি কাশেমের ভাই হুজুর মনির, ট্যাক্সি কাশেমের ভায়রা বিল্লাল, ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয় সেলিম, খাইরুল ইসলাম, মোমিন গ্রুপের রুবেল, সজল, বিপ্লব, কবির, ২১১নং ওয়ার্ডের আনসার সদস্য স্বপন; হেদায়েতুল্লাহ সরকার গ্রুপের রিপন, বাবু (সুইপার), বিপ্লব, পিচ্চি খলিল ও শরিফ, ২১১নং ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ মনির ও রাজিব, ওয়াহিদ মুরাদ গ্রুপের মনছুর (২১২নং ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ) ও সোহাগ, শুভ গ্রুপের সাবিদ, শাওন ও মাহি।

আবার সরকারি ড্রাইভার জলিল, খোকন, কাজল, বাবু, ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রাদার মিশর, হান্নান, এইচএম মহিউদ্দিন, রায়হান হোসেন রনি, এনামুল হক, গামছা শাহ আলম, রমজান, সৌরভ, শিহাব, খলিল, জান্নাত, পেট মোটা খলিল, হানিফ, আলামিন, বিল্লাল, কামাল, পলাশ সরকারি স্টাফ, কালাম মিয়াজী, রহমত মিয়াজী সরকারি স্টাফ, আক্তার ট্রলিম্যান, রমজান চতুর্থ তলা আইসিইউ, দেড়শ ইমন, চুইল্লা কাশেম’, ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের সেলিম, রনি, রুবেল, শাওন, হামিদুর রহমান সরকারি স্টাফ, বর্তমানে বাগানে ডিউটি, রানা, শিপন (ওটি), রাজিব সরকারি স্টাফ, সর্দার স্বপন ২১২নং ওয়ার্ড ও সর্দার মিন্টু, ২০২ নম্বর ওয়ার্ডের খোকন মিয়া সরকারি স্টাফ, ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডের তুহিন, ইমরান, আফসানা, পারভীন, আজিম, জুয়েল, সুমনা আক্তার আসমা, ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডের সোহেল ও ২০০ নম্বর ওয়ার্ডের ফরহাদ।
আরেক সূত্র জানায়. এসব দালাল ও কর্মচারীগণ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত মাসহারা পেয়েছেন। এর বিনিময়ে ওই সব হাসপাতালে নানা কৌশলে রোগী পাঠায়। হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে পান্থপথের ইউনি হেলথ হাসপাতাল, রিলায়েন্স হাসপাতাল (গ্রিন রোড), মাদার কেয়ার (ধানমন্ডি ২৭), হসপিটাল ২৭ প্লাস, ঢাকা ট্রমা সেন্টার (শ্যামলী), রাশমনো স্পেশালিস্ট হাসপাতাল মগবাজার ওয়ারলেস গেট, প্রশান্তি হাসপাতাল রাজারবাগ, কিওর স্পেশালিস্ট হাসপাতাল, বিওসি হাসপাতাল পান্থপথ, মদিনা হাসপাতাল যাত্রাবাড়ী, ফ্রেন্ডশিপ স্পেশালিস্ট হাসপাতাল মাতুয়াইল, প্রো অ্যাকটিভ হাসপাতাল সাইনবোর্ড, ধানমন্ডি উইমেন্স চিলড্রেন হাসপাতাল, চাঁনখারপুলের রয়েল কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা জেনারেল হাসপাতাল, মোহাম্মদপুরের ইস্টার্ন কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা হেলথ কেয়ার হাসপাতাল, ধোলাইপাড় ডেল্টা হাসপাতাল, ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতাল, রেমেডি কেয়ার হাসপাতাল, আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল শ্যামলী, ধানমন্ডি নিউ লাইফ হাসপাতাল, আইসিইউ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, রেনেসাঁ হাসপাতাল ধানমন্ডি, জিগাতলা, বিএনকে হাসপাতাল শান্তিবাগ। এসব দালালদের কারণে সারাদেশ থেকে রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, ঢামেক হাসপাতালে নবজাতক শিশুদের জন্য ৩৮টি এনআইসিইউ রয়েছে। যা রোগীর সংখ্যার তুলনায় অনেক নগণ্য। ফলে দায়িত্বরত স্টাফ ও আনসারদের মাধ্যমে দালালরা নবজাতক শিশুদের বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। রোগীর স্বজনদের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে কাজটি করেন তারা। এর এসব দালালদের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকরাও জড়িত রয়েছে।

ঢামেক এর আনসার ক্যাম্পের পিসি-উজ্জ¦ল এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকালের সময়কে জানান, হাসপাতালে মোট ৩৫০জন সদস্য ডিউটি করেন। ডিউটি শেষে তারা হাসপাতালের কর্মচারী বা ওষুধ কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যেতে পারে বলে স্বীকার করেন। এরপর তিনি প্রতিবেদককে হাসপাতালে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। এসব বিষয়ে ঢামেক হাপাসালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক এর সঙ্গে কথা বলতে তার সেল ফোনে কল করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। 

 

 


আরও পড়ুন