পরিবেশ ধ্বংস করে জেলা প্রশাসনের নামে চেয়ারম্যানের বালু উত্তোলন

news paper

শাহেদ ফেরদৌস হিরু, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ৩-১০-২০২৩ বিকাল ৫:২০

57Views

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নামে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রামু রশিদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমডি শাহ আলমের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ আছে, কক্সবাজার সদরের মাছুয়াখালী বালু মহালের ইজারা নিয়ে ইজারা এলাকার বাইরে গিয়ে রামু রশিদনগর কানছিরা ঘোনা এলাকায় ৫০টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ৫০০ একরের অধিক সরকারী বনভূমি ও কৃষি জমি ধ্বংস করে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করছেন তিনি।

জানা যায়, ১৪৩০ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখ থেকে ৩০ শে চৈত্র পর্যন্ত এক বছরের জন্য কক্সবাজার সদর উপজেলার মাছুয়াখালী বালু মহালের ইজারা দেন জেলা প্রশাসন। ইজারার শর্ত ছিল ১নং খতিয়ানের ৭টি বি এস দাগের ৪ দশমিক ৪৩ একর জমি থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে। এসব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ৩২ লাখ ১ হাজার টাকায় ইজারা পান এমডি শাহ আলম। 

সরেজমিনে দেখা যায়, রামু রশিদনগর হামিরপাড়া এলাকা দিয়ে ঢুকতেই পাহাড়ের বুক ছিড়ে কানছিরা ঘোনা এলাকা পর্যন্ত তৈরী করা হয়েছে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তার দুপাশে স্তুপ করা হয়েছে সারি সারি বালুর পাহাড়। রাস্তার মাঝখানে টোকেন নিয়ে বসে আছে ইজারাদার সিন্ডিকেটের একদল সদস্য। তারা বালু নিয়ে আসা প্রতিটি ট্রাক ও ডাম্পারকে ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে লিখা টোকেন। এরপর রাস্তার শেষ প্রান্তে যেতেই চোখে পড়ে একটি চেকপোস্ট। সেখানেও বসে আছে সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য। তারা বালুভর্তি প্রতিটি গাড়ির চালককে ৫৫০ টাকার বিনিময়ে ধরিয়ে দিচ্ছেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নাম সম্বলিত একটি ইজারার রশিদ। চেকপোস্ট পার হতেই চোখ আটকে যায় প্রায় ৫০০ একর জায়গা জুড়ে বিশাল বিশাল শতাধিক বালুর পাহাড় দেখে। সেখানে ৫০টির অধিক ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ৫০ ফুটের শতাধিক গর্ত করে পাহাড় ও কৃষি জমি ধ্বংস করে তোলা হচ্ছে দিন-রাত বালু। উত্তোলিত বালুগুলো আবার দিন-রাত ডাম্পার ও ট্রাকের মাধ্যমে রশিদনগরের বিভিন্ন এলাকায় জমা করা হচ্ছে। সেখান থেকে বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

বনবিভাগ জানায়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এর ৪ (খ) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত বনভূমির এক কিলোমিটার এর মধ্যে কোন খাল ইজারা দেওয়া নিষিদ্ধ থাকলেও আইন অমান্য করে বনভূমির দেড়শো ফুটের মধ্যে মাছুয়াখালী খাল বালু মহাল, ধলিরছড়া বালু মহাল ও পানিরছড়া বালু মহালের ইজারা দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। ফলে বন, পাহাড় ও বন্যপ্রাণির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয়েছে। 

স্থানীয়রা বলছেন, ইজারা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে দেন জেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে ইজারাদার কিভাবে বালু তুলছেন, কোথা থেকে বালু তুলছেন এবং ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে বালু উত্তোলন করছে কিনা তার খবর নেয় না জেলা প্রশাসন। শর্তের বাইরে গিয়ে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে সংরক্ষিত বনভূমি, পাহাড়, কৃষি জমিসহ পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে। বালুমহাল আইনে বালু উত্তোলনকারীদের জরিমানা করার বিধান থাকলেও রহস্যজনকভাবে জেলা প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

তবে জেলা প্রশাসনের দাবী, ইজারা শর্ত ভঙ্গ করে বনভূমি ও কৃষি জমি ধ্বংস করে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে অবগত নন তারা।অন্যদিকে, বনবিভাগের সংরক্ষিত বনভূমি, পাহাড়, গাছপালা ও বণ্যপ্রাণী ধ্বংস করে অবৈধভাবে মাটি ও বালু পাচার করলেও কয়েকজন শ্রমিককে লোক দেখানো মামলা দিয়েই যেন দায় সারছেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা। শ্রমিকদের মামলা দিয়ে প্রভাবশালী চেয়ারম্যান সিন্ডিকেটকে মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে মেহেরঘোনা রেঞ্জ কর্মকর্তা রিয়াজ রহমান ও ধলিরছড়া বিট কর্মকর্তা কর্মকর্তা মোরশেদ কবিরের বিরুদ্ধে।

যদিও বনবিভাগ বলছে, স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট ইজারাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আশেপাশের সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমির গাছ, পাহাড়ি মাটি এবং বালু পাচার করার করার অপরাধে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের সরঞ্জাম জব্দ করে কয়েকটি মামলা দিয়েছে। এবং  বনভূমির দেড়শো ফুটের মধ্যে মাছুয়াখালী খাল বালু মহাল, ধলিরছড়া বালু মহাল ও পানিরছড়া বালু মহালের ইজারা বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠিও পাঠিয়েছে। 

বালু মহাল এলাকায় কথা হয় ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনকারী এক ব্যাবসায়ীর সাথে। তিনি জানিয়েছেন, গড়ে প্রতিদিন কানছিরা ঘোনা থেকে ৫০০ এর অধিক বালুর গাড়ি বের হয়। বালুমহালের পুরো জায়গাটি বনবিভাগ ও খতিয়ানি জমি হলেও রশিদনগর চেয়ারম্যানের সিন্ডিকেটের সদস্যদেরকে ইউনিয়ন পরিষদ, বনবিভাগ ও জেলা প্রশাসনের নামে গাড়ি প্রতি দিতে হয় ৫৫০ টাকা। তাদেরকে দৈনিক প্রায় ৩ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয় হয় বলে জানিয়েছেন বালু ব্যাবসায়ীরা। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রামু রশিদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমডি শাহ আলম বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ইজারা নিয়েই বালু উত্তোলন করতেছি। ইজারার বাইরে কেন বালু তোলা হচ্ছে জানতে চাইলে কোন উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

জানতে চাইলে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের মেহেরঘোনা রেঞ্জ কর্মকর্তা রিয়াজ রহমান স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট ইজারাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আশেপাশের সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমির গাছ, পাহাড়ি মাটি নষ্ট করে বালু পাচার করার করার অপরাধে আমরা বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করে মামলা দিয়েছি। এছাড়াও ইজারা বন্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দিয়েছি। 

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, অভিযোগের বিষয়ে খোজ খবর নেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগকে নির্দেশ প্রদান হয়েছে। এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।


আরও পড়ুন