অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ে নাব্যতা সংকট
প্রকাশিত: ১৫-১১-২০২৩ বিকাল ৫:৩২
নৌ চ্যানেলে অসংখ্যা ডুবোচর থাকায় ফেরিগুলো তিন-চার কিলোমিটার ভাটিতে ঘুরে যাথায়াত করছে। এতে প্রতিটি ফেরির দ্বিগুণ সময় লাগছে। ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত সময় ও টাকা। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে পদ্মা ও যমুনা নদীতে পানি কমেছে স্বাভাবিক নিয়মে। ফলে প্রতিবারের ন্যায় চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় বেশ কিছু ডুবোচর।
সেখানে প্রয়োজনীয় পানির গভীরতা না থাকায় রো রো (বড়) ফেরিগুলো নির্দিষ্ট চ্যানেল ছেড়ে তিন-চার কিলোমিটার ভাটিপথ ঘুরে চলাচল করছে। এতে ফেরি পারাপারে সময় লাগছে অনেক বেশি।
এদিকে নৌ চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে একাধিক ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চালাচ্ছে বিআইডাব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগ। বিপুল অংকের খরচে একাধিক প্রকল্পে মাধ্যমে ড্রেজিং বিভাগ দীর্ঘদিন থেকে পরিচালনা করছে খনন কাজ। এপিপিতে নাব্যতা সংকট সমাধানের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা উল্লেখ থাকলেও রহস্যজনক ভাবে প্রতিবছর ড্রেজিং বিভাগকে একই কাজ করতে দেখা যায়। এসব কাজের ব্যাখ্যাও দেওয়া সেই পুরোনো স্টাইলেই। তবুও যেনো সবারই গা-সারা ভাব। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাই যেনো এক্ষেত্রে উদাসিন।
দৌলতদিয়া ঘাট সূত্রে জানা যায়, পদ্মা ও যমুনা নদীর মোহনায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ। প্রতিদিন সেখানে কয়েক হাজার বিভিন্ন গাড়ি ফেরি পারাপার হয়। সেখানে ফেরি চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেল রয়েছে। কিন্তু গত বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে পলি-বালু জমে নৌ চ্যানেলের দীর্ঘ অংশ অনেকটা ভরাট ও সরু হয়ে গেছে। আবার বর্ষা শেষে নদীতে পানি কমে নৌ চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে ছোট-বড় অনেক ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি রো রো (বড়) ফেরি চলাচলের জন্য কমপক্ষে ৮ ফিট পানির গভীরতা থাকা দরকার। কিন্তু নদীতে পানি কমে এই নৌপথের বিভিন্ন পয়েন্টে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় পানির গভীরতা না থাকায় চলাচলকারী বড় ফেরিগুলো নির্দিষ্ট চ্যানেল ছেড়ে গোয়ালন্দ উপজেলার আংকের শেখেরপাড়া ও শিবালয় উপজেলার নয়াকান্দি এলাকা ঘুরে চলাচল করছে। দুই থেকে তিন কিলোমিটার ভাটিপথ ঘুরে চলাচল করায় ফেরি পারাপারে স্বাভাবিকের চেয়ে বর্তমান সময় অনেক বেশি লেগে যাচ্ছে।
বিআইডাব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি কমে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে, ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নৌ চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চালাচ্ছে বিআইডাব্লিউটিএ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ফেরিমাস্টার জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট অনেক সরু। এক সঙ্গে দুইটি ফেরি চলাচল করতে অনেক সমস্যা হয়। এর মধ্যে পদ্মা নদীর মাঝখানে অসংখ্য ডুবোচর উঠেছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের এক লঞ্চচালক বলেন. নদীতে ডুবোচর থাকায় লঞ্চ চালাতে অনেক কষ্ট হয়। স্বাভাবিক চলাচল করতে অনেক পথ ঘুরে যেতে হয়। তিনি আরও জানান, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ যদি নৌরুট সচল রাখতে পরিকল্পিত ড্রেজি চলমান রাখত তাহলে এত দুর্ভোগ হতো না।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে নাব্য সংকটে পড়েছে। তাছাড়া নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রভাবশালী লোকজন। ফলে নৌযোগাযোগ এখন হুমকিতে। নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) শুরু করা খননকাজ ধীরগতিতে চলছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। এমন অভিযোগ নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ মানুষের। তাদের অভিযোগ ড্রেজিংয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারলে একসময় দেশের নদীতে চলাচলে নানান বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক নদী। পানি সঙ্কট ও তলদেশ ভরাট হওয়ায় নদীগুলো হারাচ্ছে অস্তিত্ব, সঙ্কুচিত হচ্ছে নৌপথ। খননের অভাবে দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদী এ অবস্থায় পতিত হয়েছে। ফলে নদীতীরবর্তী মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৮৮টি নৌপথে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি রুটে ঝুঁকি নিয়ে দোতলা লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করছে। বাকি ২৭টি নৌপথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুধু দক্ষিণাঞ্চলে নয়, দেশব্যাপী যত নদী ও খাল আছে সবগুলোর একই চিত্র। একই সংস্থার তথ্যানুসারে, বিগত ৪০ বছরে ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। অন্য একটি সূত্র মতে, দেশের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার নৌপথে এখন আর সহজে লঞ্চ-স্টিমার চলার মতো পানি নেই। এ অবস্থায় নদ-নদীর নাব্যতা বজায় রেখে যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে নৌপথ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে এ অবস্থার আরো অবনতি হবে। বর্তমানে দেশের ৩১০টি নদীর বেশির ভাগেই এখন নাব্যতা সঙ্কট তীব্র। এর মধ্যে ১৭৭টি বর্তমানে অস্তিত্ব সঙ্কটে। এসব নদ-নদী আংশিক কিংবা পুরোপুরি মৃত। আগামী কয়েক বছরে নদীতে পানিপ্রবাহ থাকবে কি না সন্দেহ।
কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন উৎসের ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪০টির পানিপ্রবাহ শুকনা মৌসুম শুরুর আগে থেমে যায়। অন্য দিকে প্রতি বছর তিন থেকে ছয় ফুট পলিতে এসব নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। ফলে নৌপথ বন্ধ হচ্ছে। পদ্মা-যমুনার মিলিত স্রোতে আরিচা, দৌলতদিয়া, পাটুরিয়া, নগরবাড়ী ফেরি সার্ভিস চালু রাখতে প্রতিদিন অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, নদী খননে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতায় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের অদক্ষতা, উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দায়ী। সরকার নদী খনন ও ড্রেজিংয়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিলেও এ কাজে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ; বরং সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ বেশি। অর্থ অপচয়ের মাত্রা অনেক বেশি। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নদীগুলোর সংস্কার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গত চার দশকে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষ সড়কপথে বেশি যাতায়াত করছে। একই সময়ে নৌপথে চলাচল স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় ধীরে ধীরে নদীপথ প্রাণ হারিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। অথচ নৌপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন এখনো অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও সহজ।
এদিকে, দেশের নদীগুলোকেও দূষণ থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দেন সরকার প্রধান। নদী-খালগুলো সচল রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদীগুলো হচ্ছে একটা মানুষের শরীরে যেমন শিরা-উপশিরা, ঠিক নদীগুলোও আমাদের দেশের জন্য শিরা-উপশিরা।
আগে এ অঞ্চলের নদীগুলো সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং হতো জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছোট বেলায় বাবার কাছে গল্প শুনতাম আমাদের দেশে আগে নিয়মিত ড্রেজিং হতো। ড্রেজারগুলো থাকতো আসামে। সেগুলো নেমে নিচে চলে আসতো এবং নদী কেটে সেগুলো আবার সেখানে থাকতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই ড্রেজারগুলো গানবোট হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। তারপর থেকে আর কোন নদী ড্রেজিং হয়নি।
নদীর নাব্য ধরে রাখার নির্দেশনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রথমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে সেগুলোর নাব্যতা বাড়ানো। পাশাপাশি প্রতিবছর সেগুলো রক্ষণ করার জন্য ড্রেজিং এবং নদীগুলো যেন মরে না যায় সে ব্যবস্থা নেওয়া। বদ্বীপটাকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা উন্নত জীবন দেওয়া। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, নদনদীর নাব্য রক্ষায় ড্রেজিংয়ের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে ১৭৮টি নদী পুনর্খনন করে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য ফিরিয়ে আনা হবে।
কিন্তু সবকিছুরই যেনো বাস্তবচিত্র ভিন্ন। দেশের নদ-নদী বাস্তবতা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিলুপ্ত নদী ও নৌপথ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গতিশীল করতে পারছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের আওতায় খনন ও পলি অপসারণের মাধ্যমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্য ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা থাকলেও ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধার হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার। নদী খননে বিআইডব্লিউটিএর এই ধীরগতির কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বড় বড় নদী মেগা প্রকল্পগুলোর আওতায় আনা হলেও খনন ও ড্রেজিং কাজ চলছে অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকা ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু জনগণ সুফল পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ দেননি।