দক্ষিণাঞ্চলের মাদককারবারি - বিভিন্ন দেশে সাপের বিষ পাচার করেন - প্রতিবাদ করলে পঙ্গু না হয় জেল

রাজাকারপুত্র মহারাজ চান নৌকা

news paper

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০-১১-২০২৩ বিকাল ৬:৫৮

665Views

পিরোজপুর জেলার ভান্ডারীয় উপজেলার তেলিখালী ইউনিয়নের হরিণপালা গ্রামের শাহাদাৎ হোসেন রাজাকারের বড় ছেলে মহিউদ্দিন মহারাজ নৌকার মনোনয়ন চাইছেন। তার দাদাও খবির উদ্দিন তৎকালীন সময় স্বাধীনতা বিরোধী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এমন একটি লিখিত কাগজ সকালের সময়ের হাতে এসেছে। তাতে উল্লেখ আছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মহারাজের বাবা পাকিস্তানি বাহিনীর সকল কাজে সহযোগিতায় ছিল। অবশ্য মহারাজ তা অস্বীকার করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহিউদ্দিন মহারাজ দক্ষিণ জনপদের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তিনি ও তার ভাই বর্তমান ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজের ইশারায় চলে অত্র অঞ্চলের সকল অপকর্ম। পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও হরিণাপালা গ্রামের বাসিন্দা রাজাকার শাহাদাৎ হোসেনের ছেলে তারা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি থেকে তার পথ চলা শুরু মহিউদ্দিন মহারাজের। ওই সময় তিনি ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে এজিএস পদে নির্বাচন করেন। তখন নির্বাচিত না হতে পারলেও ভাল সংগঠক হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাকে পুরস্কৃত করেন। সেই সময়ের একটি ছবি রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। এই ছবির বিষয় মহারাজ বলেন, ওই ছবি নাকি হরিণপালা সমিতি কার্যক্রমের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ বিষয় সমবায় অধিদফতরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৩ সালে ওই নামে কোন সমিতি বাংলাদেশে কোথাও ছিল না। 

২০০৩ সালে তেলিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম আহসানকে কুপিয়ে জখম করে আলোচনায় আসেন মহারাজ। বিএনপির চারদলীয় জোট সরকারের আমলে টেন্ডারবাজির পাশাপাশি নৌপথে ভারতীয় পণ্য চোরাচালান, অস্ত্র কেনাবেচা ও সাপের বিষ বেচাকেনা করেন। 

১/১১ পর গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে মহারাজ বোল পাল্টে ফেলেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে সোনার নৌকা তুলে দিয়ে ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ বাগিয়ে নেন। তারপরেও থেমে থাকেনি তার অপকর্ম। হবিগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর এপিএস হন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিপুল অংকের টাকা দিয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে নেন। এরপর জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হলে তার এপিএস পদে কৌশলে ঢুকে পড়েন। তখনও দুর্নীতি, টেন্ডারবাজিসহ চোরাচালান ব্যবসা করেছেন। পাশাপাশি স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকে বিপুল অংকের টাকা দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। নৌকার বিরুদ্ধে পিরোজপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে টাকা দিয়ে ভোট কিনে চেয়ারম্যান হন। এরপর তিনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হননি। বর্তমানে মহারাজ পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

জানা গেছে, মহিউদ্দিন মহারাজের যুদ্ধাপরাধী মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলেদের সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কারণ মহারাজের বাবা শাহাদাৎ হোসেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় তেলিখালী ইউনিয়নের অস্ত্রধারী রাজাকার ছিলেন। মহারাজের দাদা খবির উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকালীন তেলিখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। মহারাজের বাবা ও দাদা ১৯৭১ সালে তেলিখালী ইউনিয়ন হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ ত্রাসের রাজত্ব করেছেন।

এর আগে মহিউদ্দিন মহারাজ পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তখন মোটা অংকের টাকা দিয়ে তার ভাই মিরাজুল ইসলামকে ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানান। এরপর আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে তদবির করিয়ে নৌকা মার্কা নিয়ে ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বানান। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যখন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ছিলেন তখন তার এপিএস থাকা অবস্থায় পারিবারিক জমিতে জলবায়ু ট্রাস্টের প্রকল্প করে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। ইকোপার্কের নামে রিসোর্ট বানিয়ে দখল করেন মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার ভাই মিরাজুল ইসলাম ও শামসুদ্দিন।

সরেজমিনে গেলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার। তারা জানান, মহারাজ মিরাজের বিরুদ্ধে কথা বললে হয় জেলে যেতে হবে- না হয় পঙ্গু হতে হবে।

মহারাজ বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে মাদক কারবারির মাফিয়া ডন। তিনি নৌপথে মাদক এনে দক্ষিণ অঞ্চলে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এরমধ্যে ইয়াবা ও অস্ত্র চোরাচালান অন্যতম। এছাড়া নৌপথে কয়লা, বালু, সাপের বিষ, সোনা, চোরাচালান অপরাধে জড়িত। তার অন্যতম সহযোগী পিরোজপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বায়জিদ হোসাইন। 

মহিউদ্দিন মহারাজের পরিবার রাজাকার হওয়ায় এবং তার এসব অপরাধের প্রতিবাদ করায় স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে হত্যার হুমকি দেয় এবং অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনকে এলাকায় ঢুকতে দেয় না। তিনি বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই বিষয় জাকির হোসেন ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডি মডেল থানায় জিডি করেন। জিডি নং- ২১১/২০।

মহিউদ্দিন মহারাজ ও মিরাজুল ইসলামের নামে বেনামে মঠবাড়িয়া, ভান্ডারিয়া, কাউখালি ও পিরোজপুর সদরে রয়েছে সম্পদের পাহাড়। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে রয়েছে তাদের জুয়েলার্সের ব্যবসা। বিদেশে পাচার করেছে হাজার কোটি টাকা।

ভান্ডারিয়া উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সমাজসেবক এই প্রতিবেদককে জানান, মহিউদ্দিন মহারাজের বাবা যে স্বাধীনতা বিরোধী ছিল তা ওপেন সিক্রেট। এর বেশি কথা বলতে চান না। এমনকি তাদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন।

মহিউদ্দিন মহারাজের অপকর্মের প্রসঙ্গে মঠবাড়িয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক সাধারণ সম্পাদক বলেন, তাদের দুই ভাইয়ের অত্যাচারে প্রকৃত আওয়ামী লীগের কর্মীরা এলাকা ছাড়া। রাজাকার পরিবারে লোক হওয়াতে স্বাধীনতার পক্ষের প্রকৃত লোক, নেতাকর্মীদের তারা সহ্য করতে পারেন না।

ভান্ডারিয়া উপজেলার শিয়ালকাঠির একজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, মহিউদ্দিন মহারাজের বাবা শাহাদাৎ হোসেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মনির জোমাদ্দরের করাত কলের কর্মচারী ছিলেন। মহারাজ ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর অফিসের পিয়ন। তারা কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন। তাহলে ১৯৭১ সালের লুটের টাকায় তারা সম্পদ গড়েছেন।

মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার ভাই মিরাজুল ইসলাম প্রসঙ্গে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একজন সিনিয়র সদস্য জানান, ১/১১ আগে কোনদিন তারা আওয়ামী লীগ করেননি। ১৯৯৯ সালে বাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি জনসভায় তাদের দুই ভাইকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তখন আমি তাদের ভালোভাবে চিনতাম না। তবে পিরোজপুর তাদের বাড়ি হওয়ায় ছবি তুলে ছিলাম।

 

 


আরও পড়ুন