মূল্যায়নের মরীচিকায় অবমূল্যায়িত প্লেটো

news paper

ফায়েজুর রহমান, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২২-২-২০২৪ দুপুর ৩:২৫

3498Views

সাহিত্যের, দর্শনের কিংবা রাষ্ট্রজ্ঞিানের শিক্ষার্থীদের কাছে একথা খুবই পরিচিত যে, দার্শনিক প্লেটো (৪২৮-৩৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তাঁর পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিকদের কাব্যের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্যে কাব্য তথা কবিকে ‘না’ বলেছিলেন এবং কবিদেরকে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিলেন। প্লেটোর মহাপ্রয়াণের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে আমরা উপরিউক্ত মন্তব্যের পুনর্মূল্যায়নে ইচ্ছুক। কারণ, আমরা কিছুদিন পূর্বে দেখেছি যে, ইউরোপের একটি আদালত দার্শনিক সক্রেটিসকে ‘বেকসুর খালাস’ দিয়েছে ঐ অভিযোগ থেকে, যে অভিযোগের কারণে গ্রিসের আদালত সক্রেটিসকে হেমলক পান করিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে নির্দেশ দিয়েছিল। কাব্য তথা কবিদের সম্বন্ধে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্লেটোর মন্তব্যগুলোকে আমরা যদি তন্নিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে সেখানে দেখতে পাব যে, প্লেটো কবিদের পুরোপুরি ‘না বলেননি কিংবা ঝেঁটিয়ে বিদায়ও করতে চাননি বরং তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কাব্য রচনার ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে প্রকারান্তরে রাখতেই চেয়েছিলেন।

মহান দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো ছিলেন রীতিসিদ্ধ সাহিত্যসমালোচকদের অগ্রদূত। কাব্য বা কবিদের সম্বন্ধে প্লেটোর মন্তব্যগুলো ব্যক্ত হয়েছে তাঁর রিপাবলিক (Republic, 360BC) গ্রন্থে। গ্রন্থটি নানা কারণে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর মধ্যে অনন্য এবং অন্যতম মৌলিক গ্রন্থরূপে স্বীকৃত। গ্রন্থটি কথোপকথন বা সংলাপের (Dialogue) ভঙ্গিতে রচিত একটি রাষ্ট্রবিষয়ক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র কেবল শাসন ক্ষেত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই হবে আদর্শ। সেই রাষ্ট্রের নাগরিকও হবে আদর্শ। তাই রিপাবলিক-এ উঠে এসেছে আদর্শ রাষ্ট্র, শাসন-ব্যবস্থা, নাগরিকদের নানান বিষয়সহ ন্যায়-অন্যায়, রাষ্ট্র সংগঠনের উপাদান, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র, অভিভাবকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষা, রাষ্ট্রে ন্যায়ের অবস্থান, নারী-পুরুষের সমতা, যৌথ পরিবার ও বিবাহ, আদর্শ ও বাস্তব, দার্শনিকের সংজ্ঞা, দার্শনিক শাসক ও তার শিক্ষা, জ্ঞানের স্তর, আদর্শ রাষ্ট্রের পতন, উচ্চাভিলাষতন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, এবং দর্শন ও কাব্যের বিরোধ ইত্যাদি বিষয়। এই গ্রন্থের দুটি অংশে (তৃতীয় ও দশম অধ্যায়ে) তিনি কবি, কাব্য, কাব্যের নানা বিষয় ও গ্রহণ-বর্জন বিষয়ে কথা বলেছেন। বক্ষ্যমাণ আলোচনা মূলত এই দুই অধ্যায়ে প্লেটো যা বলেছেন তার উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হবে।

‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে কাব্য ও কবিদের বিষয়ে প্লেটোর মন্তব্যগুলো পর্যালোচনা দেখা যায় যে, তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন কাব্যের বিষয়-নির্বাচন, উপস্থাপন-কৌশল ও পদ্ধতি, বর্ণনা ও রচনারীতি, তাল-ছন্দ-গীতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর। কবিদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম অভিযোগ, কবিরা কাব্যের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করছে পাতালপুরীকে এবং বর্ণনা করেছে পাতালপুরীর ভীতিকর কাহিনি, বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিলাপ, দেবতা ও মর্তলোকের বীরদের শোচনীয় অবস্থা – যা তারা স্বচক্ষে দেখেনি কল্পনা করেছে মাত্র। শিল্পীর সৃষ্টি সত্য নয় বরং সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে। পাতালপুরীর এমন নেতিবাচক বর্ণনাকে কাব্যের বিষয় হিসেবে গ্রহণের অনুমতিদানে প্লেটো নারাজ। কারণ, পাতাল সম্বন্ধে কবিদের এসকল কল্পিত, অসত্য ও ভীতিকর বর্ণনা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে। তাই তিনি এসকল কল্পিত বর্ণনাকে নিষিদ্ধ করতে সচেষ্ট। তবে এইসব কাহিনি চলবে যদি কবিগণ তাঁর অনুরোধ মেনে নেন। কবিগণ যদি পাতালপুরী সম্বন্ধে আতঙ্ক প্রচার না করে সেটাকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেন, তাহলে তাঁর আর আপত্তি থাকবে না।

হোমারসহ অন্যান্য অনেক কবি তাঁদের কবিতায় বিষয় হিসেবে পাতালপুরীতে দেবতা ও বীর যোদ্ধাদের বিলাপকে রূপায়িত করেছেন। কিন্তু কবিতায় দেবতা ও বীরদের বিলাপ দেখতে চান না প্লেটো। দেবতাদের এমনভাবে উপস্থাপন করা তাঁর দৃষ্টিতে অনেক বেশি অসঙ্গত। তিনি কবিতায় দেবতাদের বিলাপকে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী। কারণ, দেবতাদের এমন বিলাপ আদর্শ রাষ্টের তরুণদের মনকে প্রভাবিত করবে এবং তারা এমন আচরণকে ত্যাগ না করে বরং এর প্রতি আকৃষ্ট হবে। ফলে সুযোগ পেলেই তারা আত্মসংযম এবং লজ্জার বদলে বিলাপের আত্মবিকারে ডুবে যাবে। মুক্ত, স্বাধীনচেতা ও মৃত্যুঞ্জয়ী বীর নাগরিক প্রত্যাশী প্লেটো চান কবিরা যেন প্রখ্যাত লোকদের ধৈর্যের কীর্তি-কাহিনি তরুণদের কাছে উপস্থাপন করে তরুণদের নৈতিক আদর্শ ঠিক রাখতে ভূমিকা পালন করেন।

দেবতাদের কিংবা রাজাদের উপঢৌকন বা ঘুষ দিয়ে বশীভূত করা যায় এমন বর্ণনা কাব্যে না রাখার পক্ষপাতী প্লেটো। কোনো দেবপুত্র বা বীর উৎকোচ গ্রহণের মতো ঘৃণ্য পাপকাজে লিপ্ত হবে এমন চিন্তা তাঁর নিকট অবিশ্বাস্য। কোনো দেবসন্তান কিংবা বীরদের সম্পর্কে এরূপ অপবাদকে অসত্য জ্ঞান করেন প্লেটো। দেবতারা সকল অপকর্মের উৎস এবং বীররা আদৌতে সাধারণ মানুষ থেকে উন্নত কিছু নয়—কবিদের কাছ থেকে যুবসমাজ এমন ভুল শিক্ষা পাক, তা তিনি হতে দিতে চান না। কারণ, কবিদের এমন মনোভাব অযথার্থ এবং এক ধরনের মিথ্যাচার। তিনি কবি এবং কাহিনিকারকে এসব মিথ্যাচার থেকে নিবৃত্ত করতে চান; নিষিদ্ধ করতে চান জগৎ-জীবন সম্পর্কে কবিদের মিথ্যাভাষণকে এবং কবিদের বাধ্য করতে চান এর বিপরীতমুখী কাব্য বা কাহিনি রচনা করতে। তিনি বিশ্বাস করেন, দেবতারা কোনো অন্যায়ের উৎস হতে পারে না। কবিদের এমন অসত্য কথা ক্ষতিকারক এবং এর ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকেরা সবাই নিজের অপকর্মকে এই বলে ক্ষমা করে দেবে যে, দেবতাদের আত্মীয়রা এমন কাজ করতে পারলে, মানুষ হিসেবে আমাদের পক্ষে এগুলো অন্যায় কিছু নয়।

কখনো উত্তম পুরুষে আবার কখনো তৃতীয় পুরুষে বর্ণিত বিষয় উপস্থাপন প্লেটোর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই রীতি অনুকরণকে অনুকরণ করে। ফলে এই রীতিতে কাব্য উপস্থাপিত হলে তা সত্য থেকে বিচ্যুত হবার এবং পাঠকদেরও বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তাঁর পরামর্শ, উপস্থাপনরীতি হবে অভিনয়ধর্মী এবং বর্ণনাধর্মী এই দুই রকমের; তবে সেখানে অভিনয় থাকবে কম আর বর্ণনা থাকবে বেশি। 

প্লেটোর নিকট হতাশার সুর অপছন্দের। তিনি দুঃখ সৃষ্টিকারী সুর থেকে দূরে রাখতে চান তাঁর রাষ্ট্রের নাগরিকদের। এজন্য তিনি ‘আয়োনীয়‘ ও ‘নীডিয়’ সুরকে পরিত্যাগের কথা বলেছেন। কারণ, এগুলো আয়েশি সুর এবং শাসকদের জন্যে অনুপযুক্ত। এই সুরগুলোতে কোমলতা আর আলস্যের উপাদান এত বেশি যে, এগুলো মাদকাসক্তির সঙ্গে তুলনীয়। এমন সুরের পরিবের্তে তাঁর পছন্দ ‘ডোরীয়’ এবং ‘ফ্রিজীয়’ সুরের; কারণ এই সুরগুলোর সামরিক তাৎপর্য রয়েছে। এছাড়া তাঁর মতে, শান্তির সুরও প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রয়োজন তখনই হবে সার্থক, যখন বীরদের বীরত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রে বাস্তব অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। অর্থাৎ তিনি আয়োনীয় ও নীডিয় সুরের পরিবর্তে যুদ্ধের ও শান্তির সুর চান। যদি কবিগণ উক্ত সুরদ্বয়ের পরিবর্তে যুদ্ধের ও শান্তির সুরে সাহিত্য রচনা করেন তবে আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের রাখতে তাঁর কোনো আপত্তি থাকবে না।

কবি ও কাব্য সম্বন্ধে প্লেটো যা বলেছেন এগুলো জানার পর পাঠকচিত্তে সম্ভবত কয়েকটি প্রশ্ন জাগতে পারে। সেগুলো হলো : কবি ও কাব্যের প্রতি প্লেটো কেন এতো বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চান? কেন তিনি কবিদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নিষিদ্ধ করতে চান? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্যে আমাদের জানতে হবে প্লেটোর কালের অ্যাথেন্সের শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্মীয় অবস্থাকে। আর এই দুই অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারলে আমরা বুঝতে পারব যে, তিনি আসলে কাব্য বা কবিকে বিদায় করতে চাননি। তিনি কাব্যের সু-প্রভাবকে গ্রহণ করতে আর কৃ-প্রভাবকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শিক্ষা। শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার তিনিই প্রথম প্রবক্তা। তাঁর সময়ে অ্যাথেন্সের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল তিন স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তরে পঠন ও লিখন, দি¦তীয় স্তরে শরীর-চর্চা এবং তৃতীয় স্তরে মাধ্যমিক শিক্ষা বা সাহিত্যপাঠ। সে সময়ে সাহিত্যপাঠ বলতে বুঝানো হতো, হোমারসহ অন্যান্য বিখ্যাত কবিদের কাব্য মুখস্থ করে আবৃত্তি করা এবং যন্ত্র সহযোগে গাওয়া। শিক্ষাজীবনে সকলকে তাই বাধ্যতামূলকভাবে হোমার-এর কাব্য মুখস্থ এবং আবৃত্তি করতে হতো। এ-কারণে প্লেটো তাঁর পরিকল্পিত রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে তা সংস্কারের চিন্তা করেছেন। তিনি যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল, যা কিছু সুন্দর তাকে ভালোবাসতে শেখানো। সেই শিক্ষা তরুণদের মন থেকে মৃত্যুভয় দূর করে সংগতি ও সারল্যকেই জীবনের লক্ষ হিসেবে গ্রহণ করতে শেখাবে। প্লেটোর বিশ্বাস এরূপ শিক্ষার ফলে আদর্শ রাষ্ট্রের তরুণেরা ভালো মানুষ হবে এবং তারা তাদের সহযোদ্ধার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দ্বিধা করবে না। এছাড়া সেই শিক্ষাব্যবস্থায় পারিতোষিক বা ঘুষ এবং অর্থের কামনাও তরুণদের জন্যে নিষিদ্ধ থাকবে।

সংগীতও সে সময়ে শিক্ষার সঙ্গে অর্ন্তভুক্ত ছিল। প্লেটো তরুণদের সংগীত-শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। কারণ সংগীতের শিক্ষা অপর যে কোনো শিক্ষার চেয়ে শক্তিশালী। সংগীতের সুর আত্মার গভীরে প্রবেশ করে তার সুদৃঢ় প্রভাবে সুশিক্ষিতকে সুন্দর করে তোলে। সংগীতে জটিল ছন্দ প্রকরণ বা যে কোন ধরনের ছন্দের ব্যবহারকে তিনি পছন্দ করতেন না। সংগতিময় জীবনকে প্রকাশ করে এমন বীরত্বপূর্ণ ছন্দ ছিল তাঁর পছন্দের। কবিতায় বা গাথায় তিনি বীরত্বব্যঞ্জক ছন্দ এবং সংগতিময় শব্দকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন।

প্লেটোর কালে প্রাচীন গ্রিসে কোনো ধর্মগ্রন্থ ছিল না। ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তে নীতিমালা বা অনুশাসনের উৎস হিসেবে প্রখ্যাত কবিদের কাব্য এবং বাণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে কবিদের বাণীকে মেনে নিয়ে তা উদ্ধৃত করা হতো। ফলে সমাজ-গঠনে কিংবা সমাজের ভালো-মন্দ নির্ণয়ে কবিতার গুরুত্ব ছিল সর্বাগ্রে। এজন্য প্লেটো কবি এবং কাব্যের শোধন এবং নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এছাড়া সেসময়ে কাব্যের সর্বময় প্রভাব মানুষের জীবনের গতি-প্রকৃতির মূল ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করত। জীবনের উপর কাব্যের এই গুরুতর প্রভাবকে প্লেটো দেখেছেন যুক্তির প্রতি-শক্তি হিসেবে। কারণ দর্শন যেখানে যুক্তি নির্ভর, কাব্য সেখানে কল্পনা ও আবেগ নির্ভর। ফলে, যে তাত্ত্বিক নির্ভেজাল যুক্তির ভিত্তিতে আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণে সংকল্পবদ্ধ; সেই তাত্ত্বিক কিছুতেই কাল্পনিক আবেগের প্রভাবকে তাঁর রাষ্ট্রে স্বাগত জানাতে পারেন না, গ্রহণও করতে পারেন না। প্লেটো মনে করতেন, কাব্য কোনো যুক্তি মানে না, বরং থাকে যুক্তি থেকে অনেক দূরে। যুক্তিহীন বা যুক্তিবিরোধী কোনো বিষয় মানুষের জীবনের চালিকা-শক্তি হতে পারে না। তাই তিনি জীবনের ওপর কাব্যের প্রভাবের দাবিকে হটিয়ে দিয়ে সেই প্রভাবকে হ্রাস করতে চেয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি কাব্যের বিরুদ্ধে, কাব্যের প্রভাবের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি দিয়ে কাব্যের অসারতা প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন।

প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের বিতাড়িত করতে চান কথাটা ঠিক নয়। তিনি চান যা কিছু ভালো কবিরা যেন কেবল তারই রূপায়ণ করেন। তিনি কবিদের বিতাড়িত না করে কবিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সর আরোপ করতে চান। সেন্সর আরোপ করা না হলে কবিদের কাল্পনিক শিল্পকর্মের প্রভাবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মন কলুষিত হয়ে যাবে। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে আদর্শ নাগরিক তৈরি প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, নাগরিকরা নৈতিক বিকারের মধ্যে বেড়ে উঠবে, তাদের আত্মা বিষাক্ত হয়ে উঠবে। এমতাবস্থায় তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ‘‘আমাদের শিল্পী হবেন তাঁরা, যারা সৌন্দর্য এবং কমনীয়তার যথার্থ রূপকে বুঝতে পারবেন। তাহলেই কেবল আমাদের রাষ্ট্রের তরুণ সমাজ স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং উন্নত পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠতে পারবে। আমাদের শিল্পীর সৃষ্টি-সৌন্দর্য আমাদের তরুণদের চোখ এবং কানকে বিশুদ্ধ পরিবেশ থেকে প্রবাহিত স্বাস্থ্যসম্মত মুক্ত বাতাসে অভিষিক্ত করে দেবে। এর প্রভাবে তরুণদের মনে শিশু বয়স থেকেই অবচেতনভাবে যুক্তির সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকবে।” প্লেটো যে কাব্যকে গ্রহণ করতে চান, তা এই মন্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘‘কাব্য যদি আমাদের আনন্দ এবং উপকার এই উভয়ের উৎস হয়, তাহলে কাব্যের কাছ থেকে আমাদের লাভ ছাড়া লোকসান হবে না।’’

সামগ্রিক আলোচনা ও প্লেটোর এরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা অত্যুক্তি নয় যে, ‘‘প্লেটো কবিদেরকে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিলেন।’’- এধরনের কথা অমূলক। বরং সত্যটা এই যে প্লেটো কাব্যের ভালো দিকটাকে গ্রহণ করে খারাপ দিকটাকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছেন।

মো. জাবেদ ইকবাল

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। 


আরও পড়ুন